বনবিভাগের কাজে জড়িয়ে থাকে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গের বনবিভাগে কাজ করা আমলার কলমে উঠে আসছে তেমন কিছু সরস গল্প বনেপাহাড়ের পাতায়। তেমনই কিছু অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন পশ্চিমবঙ্গের Chief Conservator of Forests লিপিকা রায়।
বনবিভাগের কাজে বদলি হওয়াটা চাকরির ই অঙ্গ। এক এক জেলায়, এক এক বিভাগে কাজের ধরণ
শুধু নয়, সেখানকার জঙ্গল, গ্রাম, গ্রামের লোকজন, তাদের ভাষার টান, খাওয়া দাওয়ার পছন্দ অপছন্দ
সবই বদলে যায়। আর আমি এই বদলির সঙ্গে যুক্ত বদলগুলো বরাবর ই বেশ উপভোগ করেছি।
চাকরির প্রায় বছর ন’য়েকএর মাথায় বদলি হয়ে এলাম হাওড়া জেলায়, যে জেলায় বনভূমির পরিমাণ
শূণ্য। অন্যরা ভাববে তাহলে বনবিভাগের লোকরা অফিস খুলে বসে করেটা কি? এক তো করে
সমাজভিত্তিক বনসৃজন, তা ছাড়া তারা আর যা কিছু করে, সেই নিয়েই আজকের গল্প।
হাওড়া জেলার বনবিভাগের অফিস তখন ছিল খুব ই ব্যস্ত এক বড় রাস্তার উপর, এক ভাড়া বাড়ির
দোতলায়।নিচে জুতোর দোকান, কাপড়ের দোকান কি নেই! রাস্তা দিয়ে ট্রাক গেলে দোতলায় DFO
ম্যাডামের আসনখানা কেঁপে ওঠে। এ হেন জায়গায় সবচেয়ে বেমানান যে সমস্যা , যেটা নিয়ে সবাই জর্জরিত ,
তা হল বন্যপ্রাণী জনিত সমস্যা।
যেমন ধরা যাক, সকাল দশটা নাগাদ DFO ম্যাডাম ফাইল বগলে সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন। সিঁড়ির
ল্যান্ডিং এ প্রথম যার সঙ্গে চোখাচোখি হল তিনি খাঁচায় বসে মন দিয়ে একটা সিঙ্গাপুরী কলা
খাচ্ছেন,আরো চার পাঁচটা খোসা আর এক পাউন্ড পাউরুটি পাশে রাখা আছে। আরে ? এনার তো যাওয়ার কথা
ছিল সল্টলেকে বনবিভাগের উদ্ধার আশ্রমে! জনা দশেক কে কামড়েছেন।অবশেষেরেঞ্জ অফিসারের কান
কামড়ানোর পর খাঁচায় ঢুকতেই হয়েছে।
রেঞ্জ অফিসার পাঁচুগোপাল বাবু আর মাস দুই বাদে রিটায়ার করবেন।পছন্দসইকাজ না হলে
ব্যাজার হয়ে থাকেন,কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ তৎপর হয়ে এমন সব ঘটনা ঘটান, তার ধাক্কা
সামলাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
পাঁচুগোপাল বাবু এক সকালে খবর পেলেন যে কাছেই অশত্থ গাছে যে হনুমানটা থাকে সে বেশ
কয়েকজন কে কামড়েছে। লোকজন যথারীতি “সরকারী ব্যবস্থাপনার উপর খুবই ক্ষুব্ধ” (যেন সরকার
হনুমানকে বলেছে সবাইকে কামড়ে একটা রিপোর্ট দাখিল করতে)।
তা”আমাদের রেঞ্জ অফিসার চললেন অকুস্থলে, সরকারের প্রতিনিধি হয়ে। গিয়ে দেখেন সেই
হনুমানকে খেতে দেওয়ার নাম করে কয়েকজন মিলে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়ানো, আরো নানা অত্যাচার করার
পর হনুমান ও দিয়েছে আচ্ছাসে সব কটাকে কামড়ে।তখনোঘুম পাড়ানো গুলি, বন্দুক বহু দূর। আর আজ থেকে
বিশ বছর আগে সমাজভিত্তিক বনসৃজন বিভাগ গুলোতে ঘুম পাড়ানি বন্দুক তো দূর, রেসকিউ ভ্যানের ও কেউ
নাম শোনেনি। পাঁচুগোপাল বাবু তাই ভাবলেন উনি যদি হনুমানটার সাথে ভাব জমাতে পারেন তবে হয়ত সহজে
ব্যাটাকে কব্জা করা যাবে। চারদিকে মেলার ভিড়…সবাই অল্প বিস্তর বিশেষজ্ঞের মতামত দিচ্ছে।খাঁচা
আনতে গাড়ি গেছে, অয়্যারলেসে খবর এলো গাড়ি বেশি দূরে নয়, কিন্তু হটাৎ গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে।
পাঁচুগোপাল বাবু ভাবলেন হনুমান টা কে কোনো ভাবে ধরতে যদি পারা যায় তো ভুলিয়ে ভালিয়ে গাড়ির কাছে
নিয়ে যাবেন। কোনরকম সাবধানতা ছাড়া দু প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে অশথ গাছের তলায় যেতেই, বোধ হয়
সরকারী ইউনিফর্ম পরা লোক দেখে হনুমান সিধে এসে বসল রেঞ্জ অফিসারের কাঁধে।
এই অভাবনীয় সাফল্যে রেঞ্জারবাবু বিগলিত হয়ে পবননন্দন কে কাঁধে নিয়ে রওনা দিলেন গাড়ির
দিকে।পাড়ার নেড়িরা এই উটকো ঝামেলায় এমনি ই বেশ বিরক্ত ছিল।এবারআক্ষরিক অর্থেই তারা মাথায়
ওঠার সুযোগ না পেয়ে গণ ডেপুটেশনে শুরু করে।বীরহনুমান পাঁচুবাবুকে এক থাপ্পড় মেরে পালানোর তালে
ছিল, কিন্তু অসমসাহসী কয়েকজন স্টাফ ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে কব্জা করে। খাঁচায় ভরে তাকে অফিসে আনা
হয়।
এর পর অফিসে শ্রীমান হনুমান কে অভ্যর্থনা করার জন্যে যারা ছিল তারা “ যতই অপরাধী হোক,
অপরাধীর কি খিদে পায় না?’”হনুমান বলে কি মানুষ নয়?”…বলে কলা, বাঁধাকপি,কমলা মনের সুখে এনে
দিয়েছে।কাজেই সে খেয়েছে আরো যা যা করার করেছে।
মহাসমারোহে তাকে খাঁচা শুদ্ধ গাড়িতে চাপিয়ে রওনা করার পর সবে বসে ভাবছি এতটা সময়
গেল,এবার কাজ গুলো সারি। কিন্তু উপায় নেই, বড়বাবুর প্রবেশ ভগ্নদূতের মত। “ম্যাডাম শিবু জমাদারের
খুব বাড় বেড়েছে, কাজ করছে না’, পেছন থেকে একটা ‘চুপ কর চুপ কর” আওয়াজ ভেদ করে শিবুর চ্যাঁচানি
শোনা গেল, “ও আবার সায়েবকে (সরকারী অফিসার এর neutral gender) লাগানো হচ্ছে! আমি মোটেই
হনুমানের বড় বাইরে পরিস্কার করব না,” বড়বাবু আমার সামনেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন ,”করবি না
মানে! তোর ঝাড়ু দেয়া কাজ তুই ঝাড়ু দিবি, মানুষের না হনুমানের তোকে কে হিসেব করতে বলছে?” “ ও
হনুমান কে আল্লাদ দেয়া! ও মানুষ , আর শিবু জমাদার মানুষ নয়?”
“এ্যাই চুপ সব। যাবেন আপনারা সব এখান থেকে? এটা অফিস না হরি ঘোষের গোয়াল?” মনে মনে
ভাবি “ হে ভগবান , কোথায় এনে ফেললে।“ ভগবান ভক্তিহীনার ডাকাডাকিতে মুচকি হেসেছিলেন সেটা বুঝলাম
দুদিন পর ই।
…………………………….
তালুকদারের ভালুক
দিন দুই পর সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ হতক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ঢুকতেই মায়ের সম্ভাষণঃ
“হ্যাঁরে, তোর তিনবার ফোন এসেছে,তোদের কোথায় নাকি ভালুক বেরিয়েছে?”
“অ্যাঁ !! হাওড়ায় ভালুক! সার্কাস থেকে পালালো নাকি?”
“তা আমি জানি না বাপু, আগে চা টা খাও, তারপর দেখো।“
চায়ের কাপ হাতে নেওয়ার আগেই আবার বেজে উঠল বাড়ির ফোন।
“নাও ওই তোমার ভালুকের ই ফোন হবে।“
“হ্যাঁ লিপিকা, (আমার boss) বাগনানে ভালুকের খবর শুনেছ?’
যাই হো্ক, যা উদ্ধার করা গেল ভালুক খেলিয়ে তার সাধের ভালুক টি নিয়ে বাগনান স্টেশনে ট্রেনে
ওঠার আগেই GRPর হাতে পড়ে। পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কির ফাঁকে ভালুককে প্ল্যাটফর্মে খুঁটিতে বেঁধে সে
দৌড় লাগায়। ভাবি, যাক, তবু তালুকদারের ভালুকের মত শালুক খেতে পুকুরে নামেনি, এই রক্ষে।
ত্বরিত গতিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয় এই সব ক্ষেত্রে।
চা নামিয়ে রেখে ফোনের পর ফোন চলল। আমার সহকারী অফিসার কে পাঠানোর ব্যবস্থা করা গেল।
পৌঁছে বুথ থেকে ফোন করে তিনি জানালেন প্ল্যাটফর্মে লক্ষ জনতা, প্রাইভেট চ্যানেল, ফ্ল্যাশলাইটের
চমকানিতে ভালুক দিশেহারা। বাগনান থানা থেকে ফোর্স এসেছে, কিন্তু তারা বলে দিয়েছে তারা এসব ভালুক
টালুক মোটেই পছন্দ করেনা, এক্ষুনি যেন ফরেস্টের লোকরা এসে একে নিয়ে যায়। (যেন ভালুক কে DFO
বললেই সে গাড়িতে বসে পড়বে।)
একটানা ফোনে মা তিতিবিরক্ত।“কি বলছে ওরা? ভালুক দাঁত খিচোচ্ছে, আপনি বারণ করুন?”
মোবাইল ফোন তো ছিল না তখন, বাড়ির সবেধন নীলমণি land phone টি আটকে রেখেছি আমি।
খেটেছিল বটে আমাদের স্টাফ রা। বাগনানে কোন মাঠে বেদেরা তাঁবু ফেলেছিল, সেখান থেকে এক
বেদে কে ধরে এনে, ভালুক কে চেনের তালা ভেঙে হাঁটিয়ে এনে তোলা হল গাড়িতে। গাড়ি চড়ে ভালুক এল
সাঁতরাগাছি। রেলওয়ে ডিপার্ট্মেন্টের সহযোহিতায় পুরী এক্সপ্রেস কে দাঁড় করানো হল সাঁতরাগাছি।
সেখানে তাকে তোলা হল ট্রেনে। হাওড়া পৌঁছে আবার গাড়ি ভাড়া করে তাকে নিয়ে যাওয়া হল সল্টলেক
উদ্ধার আশ্রম।
অবশেষে তিনি নিরাপদ আশ্রয় পেলেন আলিপুর চিড়িয়াখানায়। আগে খেটে খেতে হত। চিড়িয়াখানায়
অবসর ই অবসর। চিড়িয়াখানায় সেই ভালুক বহাল তবিয়তে বিরাজ করেছিল অনেকদিন।
……………………………………………………………………
কূর্ম অবতার
জীবে প্রেম যে কি সাংঘাতিক ব্যাপার তা আমি হাওড়া না এলে জানতেও পারতাম না।একদলপ্রেমিক
প্রবর জীব দেখলেই তাকে উদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর, তা সে জল থেকে তুলে হাঁস উদ্ধার ই হোক, বা গাছের
কোটর থেকে পাখির বাচ্চা উদ্ধার করাই হোক,” আমি দেখলাম তাই, যদি পড়ে যেত?”
এ রকম এক ব্যক্তির সাথে নিয়মিত ফোনালাপ হতে হতে তাঁর গলা চিনে গেছিলাম, ফোন পেলেই
প্রেশার বেড়ে দুশো হয়ে যেত।
“দিদি নমস্কার”
আমি কোন সম্ভাষণ ছাড়া সোজা খ্যাঁক করে উঠি, “ আবার কি হয়েছে?”
“না মানে আমাদের পূকুর ছেঁচতে গিয়ে একটা ছোট্ট কচ্ছপ উঠে এসেছে। এখন কি করব?”
“আর একটা জল ভর্তি পুকুরে ছেড়ে দেবেন।“ (যত্তসব””! : এটা মনে মনে, সরকারী গাম্ভীর্য বজায় রাখতে
হবে তো?)
“মানে, যদি কেউ খেয়ে নেয় ধরে?”
“তা আমায় কি করতে হবে?”
বোঝা গেল অমুকবাবু ওই কচ্ছপ শাবককে উদ্ধার করে আনবেনই,আর তার জন্য তাকে তিনশো টাকা গাড়ি
ভাড়া দিতে হবে।
আমিও সরকারী টাকা সহজে খরচ করব না, সে ও ছাড়বে না।
ঘন্টা দুই বাদে প্রচন্ড চ্যাঁচামেচি, পিওন কালিপদর গলা,” এই যে, অ মশাই, ম্যাডামের ঘরে অতগুলো লোক
ঢুকছেন যে বড়?”তার সঙ্গে সরু, মোটা নানা গলার বাক বিতন্ডা।
ছোট একটা বস্তা হাতে দাড়িওলা এক যুবক, পিছন পিছন জনা পাঁচ বালক। “যাও যাও দিদি কে প্রণাম কর”।
আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই টেবিলের তলায় বালক দল আমার শ্রীচরণ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
“মানে আমি হলাম গিয়ে…”
এরপর সেই কূর্ম অবতার কে DFO ম্যাডামের গাড়ি করে পাঠানো হল হাওড়ার গঙ্গায়। পূর্বজন্মের
পূণ্যফলে কূপ মন্ডূক (বা কূপকূর্ম) নাম ঘুচল তার।
“এর পর আমার কি কিছু কাজ আছে দিদি।?”
“হ্যাঁ , আমার মাথায় গঙ্গা জল ছিটানো।"
…………………………………………।।
লেখক পরিচিতি: লেখক পশ্চিমবঙ্গের বনবিভাগের Chief Conservator of Forests পদে কর্মরত।
Comments