উত্তরবঙ্গের মহানন্দা অভয়ারণ্য পাখিদের স্বর্গরাজ্য। সেখানে মাঝেমধ্যেই পাখিদের ছবি তুলতে চলে যান কলকাতা থেকে ডা:পার্থপ্রতিম চক্রবর্ত্তী। তাঁর ছবি আমরা আগে পেয়েছি বনেপাহাড়ের পাতায়। এবার তিনি সেখানকার পাখিদের নিয়ে একটা অদ্ভুত সুন্দর ঘটনার কথা তুলে ধরলেন তাঁর ক্যামেরা ও কলমে। এই সত্যি কাহিনীটাই আমরা এমন এক সময়ে তুলে ধরছি যখন আমাদের রাজ্য তথা দেশ এক ঘৃণ্য ও ভয়াবহ ঘটনায় শিহরিত। আর জি কর মেডিকেল কলেজের সেই মহিলা চিকিৎসকের নৃশংস হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে চিকিৎসকদের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকরাও প্রতিবাদে মুখর। আমাদের পত্রিকাও এর প্রতিবাদে গত তিন সপ্তাহে কোন প্রকাশনা বন্ধ রেখেছিল। আবার আমরা প্রকাশনা শুরু করছি, কারণ প্রকৃতিতে নানা কিছু ঘটে চলেছে। আশা করি কলকাতার এক চিকিৎসকেরই বয়ানে এই অদ্ভুত ভালোবাসার গল্প, প্রকৃতির নৈকট্যের গল্প আমাদের মনে এই দু:সময়েও আশা জোগাবে। বনেপাহাড়ে পত্রিকার তরফ থেকে ডা: চক্রবর্ত্তী ও প্রকৃতিবিদ সংযোক দেওয়ানকে আমাদের ধন্যবাদ। বনেপাহাড়ে পত্রিকার প্রতিবাদও জারি থাকবে বিচারের আশায়।
Jerdon’s Baza, নিজের বাসায়। তাও আবার বাচ্চা সমেত ! অনেক দূরে, কিন্ত ছবি টা তো নিতেই হোতো, নিয়েও ছিলাম (PHOTO 1)। ১৭ ই জুন রংটং এ ছবি টা যখন নিলাম, দূরতম কল্পনা তেও ভাবিনি যে Jerdon’s Baza এর এই পরিবারটির সাথে অদূর ভবিষ্যতে আমার একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কী করে হলো? সেটা বরং শোনা যাক, যার জন্য এটা সম্ভব হল, তাঁর মুখে….
“দিনটা ছিল ৭ই জুলাই ২০২৪। রোজকার মতো তরাই এর পাদদেশে মহানন্দা ইকো টুরিসমে চিরহরিৎ অরণ্যের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ দেখলাম একটি Jerdon’s Baza (juvenile male) আহত অবস্থায় তার বাসার এর সামনে মাটিতে পড়ে আছে।ডানায় ক্ষত আর সারা শরীরে পিঁপড়ে। একটি পা ও আঘাত গ্রস্ত।অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম ওর কাছে, আর তারপর পাশেই একটা পরিষ্কার জায়গাতে ওকে সরিয়ে রেখে বাড়ি ফিরে এলাম। কিন্তু সারা রাত এক প্রকার না ঘুমিয়েই কাটলো। পরদিন ভোর হতেই ছুটে গেলাম ওই জায়গায়। দেখলাম একই ভাবে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে রয়েছে সে। আমি তাকে খুব সাবধানে কোলে তুলে নিলাম। সেইদিন সকালেই আমি তাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি এবং আহত পাখিটির সেবাযত্ন করি। মনের মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ
করছিল, সকাল সন্ধ্যে পাখিটির যত্ন নিচ্ছিলাম। কিন্তু ৯ই জুলাই হঠাৎ জানতে পারি যে Jerdon’s Baza (juvenile) টি কে বনদপ্তরের নির্দেশ ব্যতীত নিজের বাড়িতে নিয়ে আসার একটি ভিডিও ভাইরাল হয় যেখানে আমাকে নিয়ে অন্যদের কিছু কুরুচিকর মন্তব্য আমার চোখে পড়ে। সকাল হতেই আহত পাখিটিকে আমি বনদপ্তর এর শুশ্রুষা কেন্দ্রে নিয়ে যাই এবং একরাত সেখানে
রাখি। কিন্তু মনটা ছটফট করছিল পাখিটার জন্য। পরদিন সকালেই বনদপ্তর থেকে এই পাখিটি কে কেন জানি না আবার আমার হাতে তুলে দেওয়া হয়। এক অদ্ভুত আনন্দে মনটা ভরে ওঠে। পাখিটিকে নিয়ে আসি নিজের বাড়িতে। পরের দিন সূর্যোদয় এর সাথে সাথেই পাখিটিকে নিয়ে যাই তার বাসার সামনে। ভেবেছিলাম তাকে দেখে তার মা-বাবা (Adult Jerdon’s Baza) এগিয়ে আসবে আর নিজেদের পক্ষী সন্তানকে আপন করে নিয়ে একসাথে থাকবে নিজেদের দুনিয়ায়। কিন্তু আমার এই ভাবনাকে ভুল প্রমানিত করে তার মা-বাবা তার দিকে এগিয়ে এল না বা তাকে গ্রহণও করল না। ভারাক্রান্ত মনে পাখিটিকে বাড়ি নিয়ে এলাম। অল্প অল্প খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলাম কিন্তু কখনও কখনও তো সে কিছুই খাচ্ছিল না। মনে মনে একটা অদ্ভুত ভয় কাজ করছিল, পাখিটাকে বাঁচাতে পারবো তো? হঠাৎ সেই ভাইরাল ভিডিও এর কুরুচিকর মন্তব্য গুলো কোথাও যেন মাথার মধ্যে আরও একবার নাড়াচাড়া দিল। আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম যেন বাচ্চা Jerdon’s Baza টির সেবাযত্নে একটুও কমতি না থাকে।
এইভাবে প্রায় দিন দশেক কেটে গেল। তারপর এল আমার সেই অন্যতম প্রিয় দিনটি। ওহ আপনাদের তো আমার পরিচয়টাই দেওয়া হয়নি, আমি সংযোক দেওয়ান। প্রকৃতিবিদ ও বার্ডিং গাইড। এই ঘটনায় আমাকে বনদপ্তরের কর্মচারী ছাড়াও Mahananda Eco Tourism and Conservation Society (METACOS) এর সকল সদস্য ভীষনভাবে সাহায্য করেছেন। আর একজনের সাথে তো আলাপ করাতেই হয়, তিনি হলেন পার্থ প্রতিম চক্রবর্তী। পেশায় চিকিৎসক হলেও বন্যপ্রানী , বিশেষত পাখি
ফোটোগ্রাফির এক অদ্ভুত নেশায় বার বার ছুটে আসেন উত্তরবঙ্গে। গাইড হিসাবে তার সাথে আমার পরিচয় মাত্র এক দিনের। ২৪শে জুলাই, ২০২৪ ডাঃ চক্রবর্তীর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয় Jerdon’s Baza (juvenile male)-এর। সে তখন মাংসের টুকরো মুখে নিয়ে খাচ্ছে। আর সেই ছবি ক্যামেরা বন্দী করার সুযোগ ডাঃ চক্রবর্তী যে ছাড়বেন না সেটাই তো স্বাভাবিক। আগের থেকে সে
এখন বেশ স্বাস্থ্যবান। ডাঃ চক্রবর্তী তার নাম দেন চিরো (CHIRO)।ভারি সুন্দর নামটি।
পরদিনের অভিজ্ঞতাটি সবচেয়ে দামী। ২৫শে জুলাই সকালে আমরা সকলে মিলে চিরোকে বনে নিয়ে গেলাম। রাস্তার এক জায়গা তে অনেক দুরে একটি adult Jerdon’s Baza কে স্পট করলাম (PHOTO 2)। কিন্তু এতো দুর থেকে সেটি male না female বোঝা সম্ভব ছিল না। মনের ভেতর আনন্দ
আর আশঙ্কার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ অনুভব করলাম। এবার সফল হবো তো?
চিরোকে আমরা আস্তে করে সযত্নে ছেড়ে দিলাম (PHOTO 3)। চিরো অল্প ডানা ঝাপটে পাশের একটি গাছে উড়ে গেল। একটু পরে adult Jerdon’s টি দূরের গাছ থেকে উড়ে এসে সামনের একটি অন্য গাছের ডালে এসে বসলো (PHOTO 4)। কিন্তু চিরোর থেকে অনেকটাই দুরে। বুক টা দেখে বুঝতে পারলাম যে এটি female, অর্থাৎ চিরোর মা। এর পরের অনেকটা সময় কেটে গেলো একইভাবে। মা সেই ডালে বসে ডেকেই চলল, আর চিরো তার নিজের জায়গা তে। আমাদের মনের ভেতর আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হতে থাকলো।
চিরো কে তো আমি ডাকতে শুনিনি। ও মায়ের ডাকে সাড়া দেবে কী করে? আর ওর মা ই বা কী করে চিনবে নিজের সন্তান কে? চিরোর বেঁচে থাকার জন্য দুটো জিনিস ওকে শিখতে হবে, শিকার করা আর নিজেকে শিকারিদের হাত থেকে বাঁচানো। কে শেখাবে ওকে? মা ডাকতেই থাকে (PHOTO 5), আর এরই মাঝে অন্য একটি adult Jerdon’s Baza ওখানে উড়ে আসে। চিরোর বাবা।
তখন তারা তিনজন তিনটি ভিন্ন গাছে ছিল। প্রায় ঘন্টা খানেক অপেক্ষার পর চিরো দ্বিতীয় বার উড়ে গিয়ে একটি অন্য গাছের ডালে গিয়ে বসলো। মায়ের আর একটু কাছে। কিন্তু এবার ও বসল পাতার আড়ালে, যাতে সহজ এ ওকে দেখা না যায় (PHOTO 6)। এটা কেন করল ও? তাহলে কি নিজেকে বাঁচাতে চাইছে সম্ভাব্য শিকারিদের থেকে? ওকে তো জীবনের এই প্রথম পাঠটা কেউ শেখায়নি। একেই কি বলে instinct? সারা শরীরে একটা আনন্দের শিহরণ অনুভব করলাম।
কিন্তু সেটা ক্ষণস্থায়ী। পরের দুই ঘণ্টা একইরকম কাটলো। তিনটি Jerdon’s তিনটি আলাদা গাছে। এখানে আশার আলো একটাই যে, adult Jerdon’s Baza দুটি চিরো কে ছেড়ে চলে যায় নি। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে দুটো adult Jerdon’s Baza এক জায়গা তে!!! আগে তো কখনও দেখিনি। ওদের মনের ভেতর কী চলছে বোঝা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য। আশা আর আশঙ্কার দোলাচলে সেদিনের মত ফিরে এলাম আমরা।পরদিন সকালে (২৬ শে জুলাই) আমরা আবার একই জায়গায় যাই। দেখলাম, দূরের এক গাছের ডালে একটি adult Jerdon’s Baza বসে, আর তার ঠিক নিচে এক বাদামি ডানার কিছু নড়াচড়াও লক্ষ্য করেছিলাম। মাটির এত কাছে তো adult Jerdon’s Baza উড়বে না। অনুমান করেছিলাম সেটি ছিল চিরো। কিন্তু দূরত্ব আর ঘন জঙ্গল এর জন্য কোনো ছবি নিতে পারলাম না। এক বুক আশা নিয়ে সেদিনের মতো ফিরে এলাম।
২৭শে জুলাই সকাল। এক সময়। এক জায়গা। কিন্তু অন্য দৃশ্য আর অন্য অনুভুতি। এক ডালে পাশপাশি একটি adult Jerdon’s Baza আর চিরো । এই সুন্দর মুহূর্ত টার জন্যই তো এত কিছু। আমি আর ডাঃ চক্রবর্তী একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে চেচিয়ে উঠলাম- "Yesssss! We have done it."
চিরোকে তার মায়ের কাছে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে আমরা ফিরে এলাম। যেন একটা বিজয় অনুভূতির আশ্বাস পেলাম। মনে মনে নিজেকে বললাম- 'আমি পেরেছি... আমি দেখাতে পেরেছি যে মনুষ্যত্ব এখনও হারিয়ে যায় নি, যা মানুষের সঙ্গে এক পাখিরও সুন্দর বন্ডিং গড়ে তুলতে পারে।'
মন গুনগুনিয়ে উঠলো - একদিন ও আমাকে ঠিক চিনে নেবে। আমরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে একস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ডাঃ চক্রবর্তী বললেন, কবির ভাষায় - “বন্যেরা বনে সুন্দর, আর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে”।
.................................................................................................................................
প্রিয় পাঠক, শুনলেন (পড়লেন) তো সংযোকের কথা। সংযোক তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। একটা ছোট্ট প্রাণ বাঁচানোর জন্য, তাকে নিজের পৃথিবীতে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। আর আমাকে কিচ্ছু অসম্ভব ভালো মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য। ছোটবেলায় দেখা Born Free সিনেমা টা কে এবার একটু অন্য ভাবে দেখানোর জন্য। এই সংযোকের মতো আরো অনেক সংযোক প্রতিদিন বিভিন্ন প্রতিকূলতার ভেতর নিজেদের সাধ্যমতো লড়াই করছে প্রকৃতি আর বন্যপ্রাণী দের বাঁচানোর জন্য। যা আমরা জানতে পারি না, আর ওরা জানাতে পারে ও না; বা প্রচার বিমুখ এই লোক গুলি হয়তো জানাতে চায় না। এই রচনাটি সেই সমস্ত না জানা সংযোকের এর অজানা লড়াইয়ের গল্প। পাখি দেখা আর পাখির ছবি তোলা টা এখন আমার নেশায় পর্যবসিত হয়েছে। আবার কোনোদিন রংটং যাবো, সুযোগ পেলে ওই জঙ্গল এ আবার কোনো বন্য Jerdon’s Baza কে ক্যামেরাবন্দি করবো। কে জানে সেটি এই চিরো হবে না!!!!
ছবি : ডা: পার্থপ্রতিম চক্রবর্ত্তী
লেখক পরিচিতি: লেখক একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক (এন্ডোক্রিনোলজিস্ট) ও মেডিকেল কলেজ, কলকাতার সহকারী অধ্যাপক। নেশায় একজন বন্যপ্রাণ ও পাখি প্রেমী।
সংযোক দেওয়ান মহানন্দা ওয়াড লাইফ স্যাংচুয়ারির একজন প্রকৃতিবিদ ও বার্ডিং গাইড।
Comments