সম্প্রতি বিজয়া দশমীর বিসর্জনের সময় উত্তরবঙ্গের মাল নদীতে ঘটে গেল ভয়াবহ এক বিপর্যয়। হঠাৎ আসা হড়পা বানে প্রাণ হারালেন বহু মানুষ নদীতে ভেসে গিয়ে। কিন্তু কেন হঠাৎ এল এই বিপর্যয়? প্রাকৃতিক কারণ কতটা দায়ি, কতটাই বা দায়ি মানুষের দীর্ঘদিন ধরে করে চলা প্রকৃতির উপর অত্যাচার? উত্তর খুঁজছেন রাহুল গুহঠাকুরতা।
আবার এই হড়পা বান শব্দটা খুব শোনা যাচ্ছে। হড়পা বান মানেই অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর করাল ছায়া। হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড বা কাশ্মীরের ভয়াবহ স্মৃতি এখনো মানুষ ভুলতে পারেননি। কিন্তু কী এই হড়পা বান? সাধারণ বন্যার সাথে এর তফাত কোথায়? মোটামুটিভাবে বলা যায়, বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হলে মানুষ বুঝতে পারেন। ফলে সাধারণ বন্যার ক্ষেত্রে সাবধান হওয়ার বা জানমাল বাঁচানোর কিছু সময় পাওয়া যায়। এদিকে হড়পা বান আসে আচমকা, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই করাল স্রোত সব গ্রাস করে নেয়। সাধারণত ছয় ঘন্টার থেকেও কম সময় দিয়ে বন্যা এলে তাকে হড়পা বান বলা যায়। যদিও বেশিরভাগ হড়পা বান এরচেয়েও অনেক কম সময় দেয়।
তো এই হড়পা বান হয় কেন? বহু কারণ হতে পারে। ক্রমাগত বৃষ্টিতে জলাধার থেকে জল উপচে পড়া বা ছেড়ে দেওয়ার কারণে হতে পারে। বাটির মতো আকারের পাহাড় ঘেরা উপত্যকা এলাকায় মেঘ ভাঙা বৃষ্টির কারণে হতে পারে। আবার পাহাড়ি এলাকায় হঠাৎ অতিবৃষ্টির কারণে ঘটতে পারে। যেহেতু পাহাড়ি এলাকার নদীগুলি খাড়াই পাহাড় বেয়ে নামে তাই আচমকা সবেগে বন্যার জল এসে আছড়ে পড়ে।
ডুয়ার্স এলাকার নদীগুলিতে প্রায়ই এই কারণে হড়পা বান আসে। কারণ এসব নদীগুলোর উৎপত্তিস্থল পাহাড়ে, তারা পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্নার জলে পরিপুষ্ট। এমনিতে এসব নদীখাতে জল খুব কম থাকে অথচ পাহাড়ে বৃষ্টি হলেই নাগিনীর মতো ফুঁসে ওঠে। কিন্তু এমন ধারা তো চিরকালই ছিল। তবে সে বান আসতো নির্দিষ্ট ঋতুতে। স্হানীয় মানুষ নদীর নাড়ি-নক্ষত্র জানতেন তাই জানমালের লোকসান খুবই কম হতো। তাহলে আজকাল কেন ক্রমাগত এখানে হড়পা বান আসে? কেন এই বে-মরসুমেও প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় ডুয়ার্সের মাল নদীতে এতোগুলো প্রাণের বিসর্জন হয়ে যায়? আমি বিশেষজ্ঞ নই, তবুও এলাকার বাসিন্দা তো বটেই। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে একটা ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
আগেই বলেছি,এই এলাকার নদীগুলোতে জলের উৎস পাহাড়ের অসংখ্য ঝর্না। আগে পাহাড়ে জনপদ অনেক কম ছিল, বনভূমি ছিল বেশি। এখন শহর- গ্রামে হোটেল, রিসর্ট, হোমস্টে-র রমরমা। বনভূমি ক্রমহ্রাসমান। পিচ আর কংক্রিটে মোড়া জমি জল শোষণ করেনা, সোজা ঝোরার পথে জল বয়ে যায় নদীখাতে। তাই পাহাড়ে বৃষ্টি হলেই একসাথে বিপুল পরিমাণ জল নদীপথে স্রোতের আকারে ছুটে চলে।
সমতলের অবস্থা আরও খারাপ। তৃণভূমি আর জলাভূমি সব এখন দখল হয়ে জনপদ গড়ে উঠেছে। জলাভূমি আর জল ধরে রাখে না। তৃণভূমি ছোট ছোট গুচ্ছমূলে মাটিকে আঁকড়ে ধরে না আর। ফলে নদী পাড় ভেঙে বিপুল পরিমাণ কাদামাটি আর ঘোলাজলের স্রোতে ছুটতে পারে। চারদিকে শহর। গ্রামগুলোতেও উন্নয়ন হওয়ায় কংক্রিট আর পিচে মোড়া। জল শোষা তো দূর, জনপদগুলো পুরো বৃষ্টির জলটাই নিকাশি নালার পথে উগরে দেয় নদীর বুকে।
এলাকার বনভূমি সঙ্কুচিত, ক্রমাগত উন্নয়নের দাপে নিশ্চিহ্ন হয়ে চলেছে জঙ্গল। বনস্পতির শিকড় মাটিকে বেঁধে রাখছে না। ফল ভূমিক্ষয়, ভূমির জলধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়া আর জলের বিনা বাধায় পাড় ভেঙে নদীখাতে ছুটে চলা।
সবচেয়ে বড় বিপদ নদীটাই চুরি করে নেবার অপচেষ্টা। নদীর খাত থেকে ক্রমাগত বালি-পাথর পাচার হয়ে যাচ্ছে। ফলে নদীখাত চওড়া হয়ে যায়। নদীর জল বছরের বেশিরভাগ সময় তাই স্রোত হারিয়ে শুকনো খটখটে। আবার কোথাও নদী নিজের গতিপথ বদলে ফেলছে। এই তালে জমি মাফিয়ারা নদীর চর এমনকি শুকিয়ে যাওয়া নদীখাতের জমি বেচে দিয়ে টু পাইস কামিয়ে নিচ্ছে। এবার যখন হঠাৎ নদীতে বিপুল জল এসে পড়ছে তখন বাঁচা প্রায় অসম্ভব। নদীর পাড়ে বা চরে গজিয়ে ওঠা হঠাৎ কলোনিগুলো প্লাবিত হয়। নদীবক্ষে পাথরের বাধা না থাকায় জলস্রোত বিপুল বেগে ধেয়ে আসে। অবৈধ বালি-পাথর খননের ফলে অত্যধিক চওড়া নদীখাত পার হয়ে স্রোতের আগে পালানো প্রায় অসম্ভব।
সবচেয়ে বড় বিপদ নদীটাই চুরি করে নেবার অপচেষ্টা। নদীর খাত থেকে ক্রমাগত বালি-পাথর পাচার হয়ে যাচ্ছে। ফলে নদীখাত চওড়া হয়ে যায়।
এই সব কারণগুলোর যোগফলেই ঘটে যায় মাল নদীর হড়পা বানের মতো অঘটন। দুর্ঘটনার অনেক ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। খেয়াল করে দেখবেন, কি দ্রুত জলস্রোত ধেয়ে এলো। ঘোলা কর্দমাক্ত স্রোত। কতো দ্রুত জলস্তর বেড়ে মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। নদীখাত এতো চওড়া যে অনেকে প্রাণপণে দৌড়েও পারে পৌঁছতে পারল না। জলের ধাক্কায় ঝুরঝুর করে পাড় ধ্বসে পড়ছিল।
এর সাথে যোগ হয়েছে মানুষের অতিরিক্ত আমোদগেঁড়ে মনোভাব আর প্রশাসনের অদূরদর্শিতা। অষ্টমী থেকে ক্রমাগত বৃষ্টি হচ্ছে, পাহাড়ে সমতলে। তবু হড়পা বানের আশঙ্কা কারোর মনে এল না। লোকজন শিশুসহ নদীখাতে নেমে গেলেন আর তাদের নামতেও দেওয়া হল !
যাকগে, গতস্য শোচনা নাস্তি। আশাকরি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে পরিবেশ রক্ষায় উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন। আর কোনও তাজা প্রাণ হড়পা বানে ভেসে যাবে না।
লেখক পরিচিতি: লেখক উত্তরবঙ্গের মানুষ। সাহিত্যিক, প্রাক্তন সাংবাদিক ও বর্তমানে একটি টি-এস্টেটর অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার পদে নিযুক্ত।
** নিবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
Comments