top of page
..

পর্যটন তৈরি করছে এক অতুলনীয় বন্ধন লেপার্ড আর মানুষে রাজস্হানের এক ছোট্ট গ্রামে

উদয়পুরের কাছে রাজস্হানের এক ছোট্ট গ্রাম।সেখানেই পরিবেশবান্ধব পর্যটনের জন্য তৈরি হয়েছে জীববৈচিত্র সংরক্ষণের এক আদর্শ পটভূমি।সেই নিয়ে কলম ধরলেন ড: ঐশিমায়া সেন নাগ।

নারলাইয়ের পাহাড়ে এক মা লেপার্ড

ভারত হল বন্যজীবে ভরা এক প্রাচীন ভূমি। আবার চীনের পর পৃথিবীতে দ্বিতীয় সে জনসংখ্যার বিস্ফোরণের দিক থেকে এবং চীনকেও ছাপিয়ে যেতে চলেছে আগামী ২০২৭ এর মধ্যে। এভাবে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বন্যজীবের অস্তিত্ব নিয়ে একটা সংকট দেখা দেবেই । তবে এখনও অবধি কোন জাদুবলেই হয়ত এই প্রাচীন ভূমিতে মানুষ সহাবস্হানে রয়েছে বন্যজীবদের সাথে, এমনকি বাস্তুতন্ত্রের পরিভাষায় যাদের apex predator বলে সেই বাঘ ও লেপার্ডের সাথেও। মুম্বাইয়ের মত বিশাল বড় নগর হোক বা এদিকে নারলাইয়ের মত ঘুমন্ত ছোট্ট একটা গ্রাম- ভারতীয় নাগরিক ও বন্য জন্তুরা একই জমি, একই মাটিতে রয়েছে পরস্পরের কাছাকাছি। সহাবস্হান ও সহিষ্ণুতার এই সংস্কৃতিই বন্যপ্রাণ সংরক্ষনে উপযোগী হয়েছে আজ অবধি। আজ আমাদের এই কাহিনী বন্যজন্তু ও মানুষের এই অদ্ভুত বন্ধনের কথা নিয়ে। রাজস্হানের নারলাই নামক এক গ্রাম যার পটভূমি। তার সাথে এও দেখব আমরা দায়িত্বশীল পরিবেশবান্ধব পর্যটন কিভাবে এই সহাবস্হানকে মজবুত করতে পারে জনসংখ্যা ও তথাকথিত উন্নয়নের আগ্রাসনকে ঠেকিয়ে রেখে।

"লেপার্ডের গ্রাম" নারলাই ও তার বন্য নাগরিকেরা


নারলাইয়ের মনোরম ল্যান্ডস্কেপ


এ হল রাজস্হানের আরাবল্লী পর্বত এলাকার এক ছোট গ্রাম। খাড়া উঁচু গ্রানাইট পাথরের 'এলিফেন্ট হিল' বা হাতি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্হিত গ্রাম নারলাই। পাথুরে জমি-মাটি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু বড় বড় জলাশয়, মরু অঞ্চলের গাছপালা, ঝোপঝাড় আর চাষীদের আবাদি জমি। সাড়ে তিনশোর মত মন্দিরের অবস্হান এই গ্রামে। যার জন্য এই গ্রাম স্হানীয় মানুষের কাছে পবিত্র ভূমি, তীর্থস্হান। গ্রামের ঘরে ঘরে রয়েছে মন্দির। মানুষেরা এখানে ধর্মভীরু। এখানকার অধিবাসীরা সকলে রাবারি সম্প্রদায়ের। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই রাবারিরা পশুপালনকেই পেশা হিসাবে নিয়েছিল। এখন যদিও কেউ কেউ চাষবাসের কাজও করছেন তারা।


তবে নারলাইয়ের আলাদা আকর্ষন হল এখানকার বিভিন্ন রকমের বন্যজীব। তার মধ্যে নারলাইয়ের বিখ্যাত লেপার্ডরা তো রয়েছেই, আছে নানা প্রজাতির পাখি, কুমির, ভাল্লুক, শেয়াল, সাপ এবং আরও অনেক কিছু।

আশ্চর্যজনকভাবে, মানুষে ও লেপার্ডে কোন আঞ্চলিক সীমানা নেই, নেই ভাগাভাগি। একই জমি, একই মাটিতে তাদের স্বচ্ছন্দ যাতায়াত। বস্তুতপক্ষে, এই লেপার্ডরা তাদের খাবারের জন্য অনেকাংশেই গ্রামের ওপর নির্ভরশীল। "লেপার্ডরা তো প্রায়ই গ্রামে আসে। রাতের অন্ধকারে আসে আর ওদের খাবার তুলে নিয়ে যায়- বাছুর, ছাগল, কুকুর।" বলছিলেন লালাজি। লালাজি রাবারি সম্প্রদায়ের একজন স্হানীয় মানুষ। এখানকার এক রিসর্টে গাইড হিসাবে কাজ করেন। " আমরা কিছু করতে পারি না", তার কথায়। " ওরা প্রচন্ড দ্রুত চলে আর অন্ধকারে মিলিয়ে যায় আমরা এক ঝলক দেখতে পাওয়ার আগেই", এক নি:শ্বাসে বললেন তিনি।

কিঙ্কারাম, একজন স্হানীয় কৃষক- তিনি তো ওঁর সারা জীবনেই কোন লেপার্ড দেখননি! তার কাছে লেপার্ডের অস্তিত্ব শুধুমাত্র তাদের পাগমার্ক (পায়ের ছাপ) আর লেপার্ডের ফেলে যাওয়া, আধ খাওয়া জীবজন্তুর মৃত শরীরে। "লেপার্ড প্রায়ই আমাদের গ্রামে ঢোকে ম্যাডাম। জীবজন্তু তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু আমি আজ অবধি দেখিনি"। কিঙ্কারাম ওর ক্ষেতে দাড়িয়ে বলছিল এগুলো এবং আশ্চর্য হল সেটা এমন জায়গায় যার খুব কাছেই আগের দিন সন্ধ্যাবেলা পর্যটকরা লেপার্ড দেখতে পেয়েছে। কিঙ্কারামের অবশ্য কোন দূরবীন বা বড় লেন্সওয়ালা ক্যামেরা নেই যা দিয়ে দেখে নিতে পারবে ওদের এক ঝলক ।

পালিত পশুর দল ও রাবাড়ি গোষ্ঠীর এক বালক

লেপার্ডদের এই আচরন অবশ্য কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যারা এই শ্বাপদদের চেনে ভাল করে তাদের কাছে। লেপার্ডদের বলা হয় সুযোগসন্ধানী শিকারী। তাদের মাঝেমধ্যেই দেখা যায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল আর জন বসতির সীমানায় ঘোরাফেরা করতে সহজ শিকারের সন্ধানে- যেমন গবাদি পশু বা কুকুর। মানুষের ওপর আক্রমণের ঘটনা খুবই দুর্লভ। "নারলাইয়ের লেপার্ডরা সাধারণত: রাবারিদে'র থেকে দূরে দূরেই থাকে।" বলছিলেন মানবেন্দ্র সিং। তিনি এখানে একজন প্রকৃতি বিশারদ হিসাবে আছেন। লক্ষ রাখেন লেপার্ড ও বন্যজীবদের গতিবিধি। " আগে এমন ঘটনা হয়েছে যে, পশুপালকরা তাদের পোষা জন্তুকে মারার জন্য লেপার্ডদের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে মৃত জন্তুর ফেলে রাখা শরীরে বিষ মিশিয়ে দিয়ে, যেটা লেপার্ড পরে খাবে। ওদের কাছে লেপার্ড থাকল কি থাকল না বা বাস্তুতন্ত্রে লেপার্ডের ভূমিকা কি- এসব কোন গুরুত্ব রাখে না। ওদের পোষা পশু ওদের একমাত্র আয়ের উৎস। আরে এই জায়গাটা সরকারের ঘোষনা করা কোন সংরক্ষিত অঞ্চলও নয় বলে শিকার হওয়া গবাদি পশুর জন্য কোন ক্ষতিপূরণও পায় না।" মানবেন্দ্র বোঝাচ্ছিলেন।

" তার সাথে সাথে এখানে মানুষের অস্তিত্ব ছাড়া লেপার্ডের থাকাও মুশকিল, কারণ ওদের মূল খাদ্যই হল গবাদি পশু। ওরা ওদের আশেপাশে মানুষের উপস্হিতিতে অভ্যস্হ হয়ে গেছে। এমনকি আপনি এখানে ডিনামাইটে ফাটার শব্দও শুনতে পারবেন , যেহতু আশেপাশে মাইনিং এর কাজ হয় এখানে। তাও ওরা এখানেই থাকছে।"

স্হানীয় লোকজনের আর্থিক ক্ষতি সত্ত্বেও কিন্তু এই ক্ষিপ্র শ্বাপদরা দিব্যি রয়েছে নারলাইতে। প্রকৃতিতে পাওয়া স্বাভাবিক শিকার কমে গেছে পরিবেশের ক্রমাগত অবনতির ফলে। তাই গ্রামের গবাদি পশুই ভরসা ওদের শিকারের জন্য। নীচের ছবিগুলোতে লেপার্ডের বাচ্চাদের ছবি প্রমাণ করছে বেশ আছে কিন্তু ওরা।


ছোটদের দল: নারলাইয়ের লেপার্ড শাবকেরা

কী করে এটা সম্ভব হচ্ছে? কিভাবে এই ক্ষিপ্র, নিশাচর, নির্জনবাসী শ্বাপদেরা এমন একটা জায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যেখানে পশুপালন, চাষবাস বা মাইনিং এর মত নানারকম উপদ্রব লেগে রয়েছে! বিশেষজ্ঞদের মতে, লেপার্ডদের মানিয়ে নেবার ক্ষমতা বিরাট। সময়ের সাথে সাথে ওরা শিখেছে কিভাবে মানুষের কাছাকাছি থাকতে হয় মানিয়ে নিয়ে গ্রামীন, এমনকি শহুরে এলাকাতেও। উদাহরণ হিসাবে সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশানাল পার্কের কথা বলা যায় মুম্বাইয়ের। ভারতের দ্বিতীয় জনবহুল এই শহরের নিকট অবস্হিত এই উদ্যানে ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে প্রায় ৪০ টি লেপার্ডের বাস। ভারতীয় সমাজে প্রথাগত ভাবে বন্যজীবের প্রতি সহনশীলতার একটা মনোভাব এই সব ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে।

কিন্তু, এটাও ভয় হয় যে, যেভাবে ওদের প্রাকৃতিক বাসস্হান ধ্বংস হচ্ছে বা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাতে মানুষের সাথে সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে বেশি বেশি করে। সারা দেশ থেকেই তেমন খবর আসছে।

একজন রাবাড়ি সম্প্রদায়ের প্রবীন মানুষ

অনেক ক্ষেত্রে মানুষ নির্মম ভাবে হত্যা করছে এই অতুলনীয় সুন্দর জীবগুলোকে। নারলাইতে অবশ্য তেমন চরম কোন ঘটনার কথা শোনা যায় না। যদিও অতীতে বেশ কিছু হত্যা বা বিষ দেবার কথা শোনা গেছে, কিন্তু এখন বাসিন্দারা লেপার্ডদের উপস্হিতি মেনেই নিয়েছে বেশ আর লেপার্ডরাও শিখে গেছে কিভাবে মানুষের সাথে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে চলতে হবে। ইদানিং দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন নারলাইয়ের এই প্রত্যন্ত গ্রামে লেপার্ডেদের অর্থকরী সম্পদ হিসাবে প্রতিপন্ন করেছে।

"পর্যটন এখন এই অসংরক্ষিত অঞ্চলে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। লেপার্ড সাফারি থেকে যে আয় হচ্ছে, তা স্হানীয় মানুষের পক্ষে উপযোগী হয়েছে। পর্যটনের জন্য এখানে প্রকৃতিবিদ, প্রকৃতি পর্যবেক্ষনকারী ও অন্যান্য কর্মচারীদের উপস্হিতি বাড়ছে। কিছুদিন আগেই আমরা একটা লেপার্ড শাবককে উদ্ধার করি, যেটা খরগোশের মত ছোট জন্তু ধরার জন্য পাতা ফাঁদে আটকে পড়েছিল। আনন্দের কথা, ওকে ওর মা'র কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।" মানবেন্দ্রর কথায় স্পষ্ট হচ্ছিল নারলাইতে লেপার্ড পর্যটনের বাড়তে থাকা তাৎপর্যের কথা।

লেপার্ড ট্যুরিজম ভারতে একটা নতুন বিষয়, যেখানে বন্যপ্রাণীদের মধ্যে জাতীয় পশু বাঘ বেশির ভাগ স্পটলাইট কেড়ে নেয়।

নারলাইয়ের জলাশয়গুলো কুমীরের আবাসস্হল

নীলগাঈ

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ওয়াইল্ড লাইফ পর্যটন অন্যান্য জীবজন্তু, বিশেষত: লেপার্ডের মত গ্ল্যামারাস পশুর দিকেও নজর ফেলেছে। যদিও ট্যুরিজম সব সময় যে ভাল করে তাও নয়, বিশেষত: নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেড়িয়ে গেলে। এই অঞ্চলেই বেরা নামক জায়গা, যেখানে লেপার্ডের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করা হয়, সেখানে পর্যটকের সংখ্যা ইদানিং খুব বেড়েছে। পরিবেশবিদদের মতে, বেশি বেশি পর্যটককে জায়গা দিতে যেভাবে পরিকাঠামো বাড়ছে সেখানে তাতে লেপার্ডদের থাকার জায়গাই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। এমনকি কিছু হোটেল মালিক নাকি টোপের ব্যবস্হা করছেন লেপার্ড ডেকে আনার জন্য এমনটাও শোনা যাচ্ছে।

যাইহোক, এই নারলাইতে কিন্তু এখনও অবধি এই লেপার্ড পর্যটন ভালমতই সাহায্য করছে মানুষ ও লেপার্ড- দুই প্রজাতিকেই। পর্যটকরা লেপার্ড সাফারির বাইরেও গ্রামে 'ভিলেজ-ওয়াক' করেন, স্হানীয় মন্দির ও অন্যান্য আকর্ষন ঘুরে ঘুরে দেখেন। গ্রামীন হস্তশিল্পের কেনাকাটা থেকেও লাভ হয় গ্রামবাসীদের।




যদিও ভারতে কঠোর বন্যপ্রাণী আইন রয়েছে, তবুও দিনের শেষে নারলাইয়ের মত অসংরক্ষিত অঞ্চলে এই অপূর্ব সুন্দর প্রাণীদের টিকে থাকতে হলে স্হানীয় মানুষজনের সহনশীলতা ও সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। যথোপযুক্ত পরিবেশ বান্ধব পর্যটন এতে যথেষ্ট সহযোগীতা করতে পারে স্হানীয় মানুষের আয়ের উৎস হিসাবে। এই নির্জনবাসী পশুরা তাহলে মানুষের এই বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে হারিয়ে যাবে না।


ছবি: লেখক।

লেপার্ডের ছবি: মানবেন্দ্র সিং, নারলাই।



লেখক পরিচিতি: ড: ঐশিমায়া সেন নাগ বায়োকেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট। বর্তমানে বন্যপ্রাণ ও সংরক্ষণের কাজে নিবেদিত। কানাডা থেকে প্রকাশিত শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট worldatlas এর অন্যতম সম্পাদক। বর্তমানে বাংলা ওয়েবজিন 'বনে-পাহাড়ে'র সহ-সম্পাদিকার দায়িত্বেও তিনি যুক্ত।

174 views0 comments

Comentários


Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page