top of page

কোয়েলের কাছে, পূর্ণিমার রাতে

  • ..
  • Jan 14, 2022
  • 7 min read

Updated: Jan 21, 2022

বনেপাহাড়ে'র পাতায় ভ্রমণ-আখ্যান। ঝাড়খন্ডের পালামৌতে দোলপূর্ণিমায় ভ্রমণের গল্প শোনালেন সুমন্ত ভট্টাচার্য্য







বসন্তপূর্ণিমার ছুটিতে সেবার পালামৌয়ের পথে। যে পালামৌ সঞ্জীবচন্দ্রের, যে পালামৌ বিভূতিভূষণের, যে পালামৌতে বুদ্ধদেব গুহের হলুদ বসন্ত ডাক দেয় বারবার আরণ্যক মনকে। এই পালামৌ আজও দুর্গম, আজও তার কত না অন্ধকার অরণ্যপথ অনাবৃষ্কিত, সে আজও সবার কাছে নিজেকে মেলে ধরেনি। সেই সবুজে ঢাকা পথের ধারে ধারে, আদিবাসী মানুষের কুটীরের ওপর শিমূল ফুলের ঝরে পড়ার মৃদু শব্দে, পাহাড়-জঙ্গলের বুক চিরে বয়ে যাওয়া শুখা নদীর সরু জলধারায়, নিঝুম রাতে বনের গভীরে বন্য পশুর আদিম চিৎকারে তবু ডাক দিয়ে যায় ছোটনাগপুরের প্রকৃতি। সবাই যে শুনতে পাবে সেই ডাক তেমন নয়। মেখে নিতে হবে বনপথের লাল ধুলো, নদীতীরে জোৎস্নারাতের চাঁদের আলোয় কান পাততে হবে টিটিপাখির ব্যাকুল ডাকে, শুনে নিতে হবে শীতশেষের ঝরাপাতার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ার মর্মর-ধ্বনি। তবেই ছুঁতে পারা যাবে সবুজের মাঝে জেগে থাকা জোৎস্নাধোঁয়া অরণ্যকে, পাহাড়কে, তার মানুষকে, আদিম ভারতকে।

এই আমার দ্বিতীয় পালামৌ ভ্রমণ।প্রথমবার পালামৌ ঘুরতে যাচ্ছি শুনে আঁতকে উঠেছিল অনেকেই। ওরে বাবা, সে তো মাওবাদীদের খেলার মাঠ! চারিদিকে ডাকাত, লুঠেরা!! অজানি দেশের নাজানি কি'র আতঙ্ক। অথচ এইসব জায়গাই ছিল একসময়ের বাঙালীর 'পশ্চিম'। তার দ্বিতীয় ঘর। নদী, বন, পাহাড়, টাঁড় পেরিয়ে প্রকৃতি ও মানুষের যে স্বপ্নরাজ্যর ছবি আঁকা আছে সঞ্জীব চাটুজ্জে হয়ে বিভূতিভূষণ, বুদ্ধদেব গুহর তুলির মত কলমে। যাওয়া হত না যদি না বারবার ভরসা যোগাতেন কিছু বন্ধু, যারা কাজ আর ভ্রমণের সূত্রে খোঁজ রাখেন সে দেশের। আর ক্রমাগত উস্কে না যেত বুদ্ধদেব গুহ'র একটার পর একটা রচনা। পালামৌয়ে'র প্রকৃতিকে দেখলাম, অনুভব করলাম নেতারহাটের কুয়াশাঘেরা পাহাড়ি পথে, মহুয়াডাঁরের সবুজ রাস্তায়,মারোমারের অরণ্যে, হুলুক পাহাড়ের ছায়ায়। স্বল্প সময়ের আলাপ বাড়িয়ে দিল আরও দেখার খিদে। আর যেটা মনে হল ওখানকার আদিবাসী মানুষ এখনও রয়ে গেছেন বিভূতিভূষণের সময়েই। সেই দারিদ্র, সেই স্বল্পতেই তৃপ্ত মানুষের দল।

আমার মুখে গল্প শুনে চেপে ধরেছিল বিভিন্ন বয়সী ভ্রমণ-পাগল বন্ধুরা। নিয়ে যেতে হবে পালামৌ। দোলপূর্ণিমার দু’দিন আগে তাই ১৩ জন মিলে হইহই করে উঠে পড়লাম রাতের হাওড়া- রাঁচি এক্সপ্রেসে। গল্পে গল্পে ট্রেনের দোলায় একসময় ঘুম এল আর সাত সকালে চোখ খুলতে দেখলাম ট্রেন ঢুকছে রাঁচি স্টেশনে।স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল গাড়ি। বাক্স-প্যাঁটরা স্করপিওতে চাপিয়ে ছুট কুরু, লোহারদাগা হয়ে পালামৌর পথে। তার আগে রাঁচিতেই সবাই সেরে নিয়েছি জলখাবার। শহর ছাড়তেই একে একে দেখা দিল ছোট পাহাড়, ইতি-উতি অরণ্যের ছায়া।মনে আসছে সঞ্জীবচন্দ্র- "বঙ্গবাসীর কেবল মাঠ দেখা অভ্যাস, মৃত্তিকার সামান্য স্তূপ দেখিলেই তাহাদের আনন্দ হয়, অতএব সেই ক্ষুদ্র পাহাড়গুলি দেখিয়া; যে তৎকালে আমার যথেষ্ট আনন্দ হইবে ইহার আর আশ্চর্য কি!"

চলেছি পালামৌর পথে

মাঝরাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে গাড়ু পৌছতে অনেক বেলা হয়ে গেল। একটু আগেই ফেলে এসেছি কোয়েল নদী আর নেতারহাট যাওয়ার পাহাড়ি পথ। গাড়ুতে পুরানো বন্ধু ফৈয়াজ অপেক্ষা করছিল দু’টো জিপ নিয়ে। জঙ্গলের মেঠো পথে খোলামেলা এই গাড়িতেই জমে অ্যাডভেঞ্চার!তাই গাড়ি বদলে এবার বাঁড়েষাড়ের পথে।

বাঁড়েষাড় একটা ছোট গঞ্জ। বনের পাশেই। এখানেই দুপুরের খাওয়া আর আগামী দু’দিনের বাজার-হাট করে নেওয়া। মুরগী, ডিম, চাল থেকে সব্জি সব। বাংলোগুলোয় চৌকিদাররাই রান্না করে দেন। খাওয়া আর বাজারের পাট চুকিয়ে আবার সবুজ বনের মধ্যে দিয়ে জিপ ছুটল আকসি বনবাংলোর পথে। পথের ধারে ফেলে রেখে গেলাম মারোমারের অপরূপ বনবাংলোকে। এখনও মনে তাজা আগেরবার এখানে রাত কাটাবার সুখস্মৃতি!কিন্তু এবার তো গন্তব্য অন্য। দেখতে দেখতে খোলা প্রান্তর আর পাহাড়-বন-নদীতে ঘেরা আকসি বাংলো এসে গেল।কি দারুণ পটভূমিতে কে যেন বসিয়ে রেখেছে পুরানো দিনের বাড়িখানা। উত্তেজনায় সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। কিন্তু, একি! বাংলোয় তো মেরামতি চলছে!সব এলোমেলো! কোথায় থাকব এতজন! অথচ অনলাইন রিজার্ভেশনের কাগজ হাতে। অগত্যা ফোন ঘোরাও রেঞ্জ অফিসারকে। অনেক কষ্টে মিলল সিগন্যাল। কিন্তু তিনি বলে দিলেন তার অপারগতার কথা। বদলে জায়গা হবে মহুয়াডাঁরের বনবাংলোয়।

অকসি বনবাংলো

আসলে এখানে পর্যটন এখনও ছন্দে ফেরেনি, পেশাদার হয়নি দীর্ঘদিনের ভয়ের পরিবেশে সব বন্ধ হয়ে থাকার পর। বন-পাহাড়ের দেশে এমনটা যেন হয়েই থাকে।সুতরাং চালাও পানসি....গাড়ি ছুটল মহুয়াডাঁরের পথে। লাতেহার জেলায় মালভুমির ওপর ছোট শহর। তারই শেষ প্রান্তে গাছে গাছে ঢাকা বন বাংলো। সেখানে গিয়ে চৌকিদারকে এক প্রস্হ খোঁজাখুজির পর পাওয়া গেল ঘর।তখন মনে হচ্ছিল ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র সেলুলয়েড থেকে উঠে এসেছি আমরা যেন। প্রস্তুতি নিয়ে এসেও সেইরকমই অজানায় অ্যাডভেঞ্চার!

সব ক্লান্তি আর বনদপ্তরের ওপর রাগ নিমেষে উধাও হয়ে গেল, যখন উঠোন আলোয় ভাসিয়ে বড় গোল শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠল আকাশে। আজ ঘরে কেউ আলো জ্বালিও না। জ্যোত্স্নাধোয়া প্রাঙ্গণে আজ শুধু মৃদু স্বরে গল্প আর গান। যে মহুয়া জোগাড় হয়েছিল আসার পথের ধারে আদিবাসী রমণীদের থেকে, তার আজই সদ্বব্যহার। সে এক ডাইনি জ্যোৎস্নার নেশাধরা রাত।

মহুয়াডাঁরের বনবাংলো চত্ত্বর

পরদিন সকালে স্হানীয় বাজারে পুরি-সব্জিতে ব্রেকফাস্টের পর আমরা চললাম লোধ ফলসের পথে। মহুয়াডাঁর থেকে ঘন্টাখানেকের পথ। আদিবাসী গ্রাম, মহুয়া গাছের জঙ্গল পার হয়ে।লাল ধুলো উড়িয়ে ছুটছে জিপ। জিপ থেকে নেমে চড়াই ভেঙ্গে জলপ্রপাতের কাছে যাওয়া। বুঢ়হা নদী ছত্তিশগড় হয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে উঁচু পাহাড় থেকে।ঝাড়খন্ডের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত। এদিক ওদিক থেকে নামছে জলধারা। প্রকৃতির এই বিস্ময়ের সামনে সব অনুভূতি থমকে যায় কোন আদিম পৃথিবীর ডাকে। নাম না জানা কত পাখি জানান দিচ্ছে মধুঋতুর আগমনবার্তা। আজ দোল।

লোধের ধারে আমরা

লোধ ফলস: ঝাঁপিয়ে পড়েছে উঁচু পাহাড় থেকে

প্রকৃতির মাঝে আমরাও তাই আবিরে রঙীন হলাম লোধের ধারে। জলের ছিটে ভিজিয়ে দিচ্ছে মুখ-শরীর। তারপর তো ফেরার পালা লোধকে বিদায় দিয়ে। মহুয়াডাঁরে ভোজন সেরে আজ সোজা চলে যাব আমরা কেঁচকি বনবাংলোয়। পথ চলব পালামৌয়ের প্রকৃতিকে গায়ে মাখতে মাখতে। এই পথের কত কথা পড়েছি বুদ্ধদেব গুহ’র ‘কোয়েলর কাছে’, ‘কোজাগর’, ‘জঙ্গলের জার্নালে’। পাহাড়, বন, আর নদী। মাঝে মাঝে আদিবাসী গ্রাম আর ছোট বাজার-হাট। প্রকৃতির নিজের হাতে বানানো স্বর্গ-রাজ্য। পলাশ, শিমূলের রঙে সেজেছে বসন্তের পথ।পার হয়ে যাব মারোমার, বড়েষাঁড়, গাড়ু, কেঁড়, বেতলার সবুজ অরণ্য। পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে কালো পিচের রাস্তা। স্হানীয় ওঁরাও উপকথা অনুযায়ী লাগাতার বৃষ্টিতে সেই কোন প্রাচীনকালে এই উপত্যকা ভরে গেছিল জলে। গাছের টিয়াপাখিরা গাছ ছেড়ে উঠে পড়েছিল দু’পাশের পাহাড়ে। তারা বাসার জন্য যে গর্ত করেছিল, তা দিয়েই নাকি একসময় জমে থাকা সব জল বার হয়ে যায়। উপত্যকা আবার ভরে ওঠে সবুজে, প্রাণে, কোলাহলে। সেই ঘটনার স্মৃতিই নাকি এখনও বহন করছে সুগ্গা-বাঁধ।সেখানে বুঢ়হা নদী বয়ে চলেছে ভীষণা খরস্রোত নিয়ে। পথে যেতেই পড়ে এই জায়গা। একটার পর একটা তিরতিরে জলস্রোত ছাড়িয়ে পৌছতে হল বড় প্রপাতের ধারে।খরস্রোতা নদী বয়ে গেছে পাথর কেটে।পাথরের গায়ে অসংখ্য ছোট-বড় গর্তে যেন লেখা রয়েছে অতীতকালের গল্পকথা। প্রপাতের ওদিকে ঘন অরণ্য।বাঁদরের দল জল খেতে এসেছে। জঙ্গল থেকে ফিরছে আদিবাসীরা। আদিম প্রকৃতির মাঝে পড়ে ভাষা হারিয়েছি আমরা।

সুগা বাঁধে

শেষ অবধি সুগ্গা-বাঁধকেও ফেলে এলাম ধীর পায়ে। মারোমার পার হয়ে এল মিরচাইয়া ফলস্।কোন দূরের বনপথ পেরিয়ে আসছে এ জলধারা! কিছুক্ষণ তন্বী মিরচাইয়ার ধারে বনের ছায়ায় জিরিয়ে নেওয়া। এরপর পথে পড়ে বিশাল কোয়েল নদী। ঘন বনের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে। অপরাহ্নের আলোয় কোয়েলের ব্রিজের ওপর থেকে দিগন্তে বিলীন হওয়া নদী আর পাহাড়কে জেনে নেওয়ার পালা। একপ্রস্ত ফটোশ্যুট। বর্ষাকালে এই নদীতে যখন বান আসে তখন নদীর বুকে পাথরগুলো দাঁতের মত উঁচু হয়ে থাকে। গোটা এলাকার সব নদী এসে মেশে কোয়েলের বিশাল বুকে। দাঁত-বের-করা নদী স্হানীয় আদিবাসী ভাষায় ‘পালামু’। তার থেকেই নাকি এই জায়গার নাম ।

কোয়েলের কাছে

সব পথচলারই শেষ থাকে। বেতলা পেরিয়ে সন্ধ্যার কন্ঠ লাগিয়ে পৌঁছে গেলাম কেঁচকি।কোয়েল আর ঔরঙ্গার সঙ্গমে বনবাংলো। সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ শ্যুটিংস্পট।

মায়াবী সূর্যাস্ত কোয়েলের বুকে

এই বাংলোর ঘর, বারান্দা, উঠোন আর ওই নদীর চরে আঁকা কত জলছবি মাণিকবাবুর মনক্যামেরায়। পৌঁছে দেখি কোয়েলের ওপারে আশ্চর্য সুন্দর এক সূর্যাস্ত হচ্ছে আকাশ, জল আর অরণ্যকে গোধূলির রঙে সাজিয়ে। প্রকৃতি খেলছে হোলি। ওদিকে ঔরঙ্গার রেলব্রীজের ওপর, বনের মাথায় থালার মত পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। চৌকিদার দীননাথ এসে দেখা করে গেলেন। বাজার করে আনা সামগ্রী থেকেই আজ রাতে খিচুরি, ডিম-কষা আর আলু-ছোকা করে দেবে। কথায় কথায় আঁধার নেমে এল। এই বাংলোয় মোমবাতিই ভরসা। বিদ্যুৎ বা সোলার কোনটাই নেই। এমনটাই তো চায় অরণ্যমন। এই আঁধারেই নদীর চরে জেগে উঠছে জ্যোৎস্না রাত। মিলে মিশে একাকার দূরের পাহাড়, বন আর নদী। আমরা ক’জন হাঁটতে বার হলাম নদীর বালুচরে। চকচক করছে চরাচর। ওপারের বনে একটা টিটি পাখি কখন থেকে ডাকছে-‘ ডিড ই্যু ডু ইট?ডিড ই্যু ডু ইট?’ সঙ্গীর সাড়া পেয়ে ওটা বোধহয় উড়ে গেল টি-টি-টি করে। রেলব্রীজের ওপর দিয়ে একটা ট্রেন চলে গেল ঝমঝম করে। কোন দেশে ডাক দিয়ে গেল কে’জানে? এমন রাতে মনে পড়ে যায় মানুষের কত স্মৃতি, এমনই কত ফেলে আসা রাতের কাহিনী...অন্য জন্মেরও হয়ত! আমাদের মধ্যে একজন আবৃত্তি করে উঠল হুমায়ন আহমেদ-“...প্রান্তরে হাঁটব, হাঁটব আর হাঁটব-/পূর্ণিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে/চারদিক থেকে বিবিধ কন্ঠ ডাকবে- আয় আয় আয়”।

দোলপূর্ণিমার চাঁদ ঔরঙ্গার ব্রীজের মাথায়

পরদিন সকালটা পাখির কাকলিতে মুখর। ভোরের কুয়াশাভেজা জঙ্গলপথে, রেলগেটটা পার হয়ে সড়ক অবধি ঘুরে আসা কখনও, তো আবার নদীতে নেমে যাওয়া গোড়ালি ডোবানো কাকচক্ষু জলে। বাংলোর হাতায় এসে পড়েছে মিঠে রোদ।

অরণ্যের দিনরাত্রির সেই বাংলো

তারপর বেলা বাড়লে স্নান নদীর প্রাণজুড়ানো ঠান্ডা জলে। তার জলে শরীর ডুবিয়ে বসে থাকলে কত কথাই না কানে কানে বলে যায় কোয়েল। তাকে ছেড়ে যেতে মন চায় না। বন্য প্রেমিকার ডাক যেন... তবু তো যেতে হয় ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি জমা রেখে। আজ আমাদের বেতলায় রাত্রিবাস। দু’পাশে পলাশের বন দেখতে দেখতে এসে গেলাম বেতলা। কেঁচকি থেকে একঘন্টার দূরত্ব। সেখানকার বনবাংলো আর ট্রি-হাউসে সবাই উঠছি আজ। একটু দূরে চরে বেড়াচ্ছে হরিণের পাল। আর একদল বাঁদর। অলস দুপুর কেটে গেল পাখিদের ডাক শুনে। বেশ ক’টা নীলকন্ঠ উড়ে গেল। বিকেলে গাড়ি নিয়ে হাজির ফৈয়াজ। যাব কমলদহে। বেতলার জঙ্গলের মধ্যেই পড়ে এই সরোবর। উমাপ্রসাদবাবুর বইতে পড়েছি এর কথা। সন্ধ্যায় ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে জল খেতে আসা পশুরা দর্শন দেন কখনও সখনও। যাওয়ার পথে দেখে নিলাম কয়েক শত বছরের প্রাচীন পালামৌয়ের পুরানো দুর্গ। দোর্দণ্ডপ্রতাপ চেরো রাজাদের বানানো। গভীর অরণ্যের মধ্যে দীর্ঘকাল তারা ছিলেন অপ্রতিরোধ্য।

ইতিহাস ফিসফিস কথা কয়: পালামৌ দুর্গর ধ্বংসস্তূপ

তবে মোঘল আক্রমণে একসময় ধ্বস্ত হয় তাদের রাজত্ব।আজ শুধুই ধ্বংসস্তূপ। সাবধানে ভাঙ্গা সিঁড়িতে পা ফেলে উপরে উঠতে পারলে দূরের জঙ্গল, ঔরঙ্গা নদী আর উল্টোদিকের পাহাড়ে চেরোদের নতুন দুর্গের ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়বে। সে এক মায়াবী, বন্য অলিন্দ। ভগ্নপ্রায়, কিন্তু আজও জানান দেয় তার পুরানো ঐশ্বর্যের ইতিকথা। বিদায় ইতিহাস। আবার বনপথে লাল ধুলো উড়িয়ে কমলদহ। স্বচ্ছ জলে গাছেরা ছায়ায় ছায়ায় ছবি এঁকেছে। অপেক্ষার পালা। তবে আজ বোধহয় ভাগ্যে ‘সাইটিং’ নেই। ফৈয়াজ বলল, এখানে যখন পেলাম না ভাইয়া, কাল ভোরে বেতলা পার্কে সাফারিতে দেখতে পাবই। জানোয়াররা বোধহয় ওদিকেই সব। (জানিয়ে রাখি পরের দিন ভোরের আলোয় সাফারিতে সত্যিই দু’টো বাইসনের দল দেখেছি খুব কাছ থেকে। চিতল, সম্বর তো ছিলই।) ফেরার পথে বনের মাথায় টকটকে লাল সূর্যটা ধীরে ধীরে অস্ত গেল। ছায়া নেমে এল অরণ্যে।

পথ এসেছে কমলদহে

















বেতলা ন্যাশানাল পার্কের বাসিন্দারা




অদ্য শেষ রজনী। বনবাংলোর বারান্দায় বসে মৃদুমন্দ বাতাসে মায়াবী বনজ্যোৎস্না মাখছি গায়ে, মাখছি মনে।দূরে কোথা হতে হোলির পরবের দেহাতি গান ভেসে আসছে।কাল আলো ফোটার আগে সাফারিতে যাওয়ার পালা। তারপর এবারের যাত্রা সাঙ্গ। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে ঘরে। ফেরারি মনকে আবার পোষ মানানো কাল থেকে। তবু প্রকৃতি যাকে ফেলেছে বাঁধনে, মুক্তির স্বাদ যে একবার পেয়েছে পাহাড়ে-বনে-নদীর স্রোতে, তাকে বারবার ডাকবে পালামৌ। ছুটে আসতেই হবে কোয়েলের কাছে।

"..জ্যোৎস্না যে এত অপরূপ হইতে পারে, মনে এমন ভয় মিশ্রিত উদাস ভাব আনিতে পারে, বাংলাদেশে থাকিতে তাহা কোনদিন ভাবিও নাই! ফুলকিয়ায় সে জোৎস্না-রাত্রির বর্ণনা দিবার চেষ্টা করিব না, সেরূপ সৌন্দর্যলোকের সহিত প্রত্যক্ষ পরিচয় যতদিন না হয় ততদিন শুধু কানে শুনিয়া বা লেখা পড়িয়া তাহা উপলব্ধি করা যাইবে না- করা সম্ভব নয়”(আরণ্যক)।



বসন্তের বেতলা বনে।

লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় চিকিৎসক। প্রকৃতি ও অরণ্যপ্রেমী। 'বনেপাহাড়ে' ওয়েবজিনের সম্পাদনার দায়িত্বে।


ছবি: লেখক
























1 Comment


Mousumi Banerjee
Mousumi Banerjee
Jan 15, 2022

খুব ভালো লাগল। বিভূতিভূষণ, বুদ্ধদেব গুহর লেখা মনে পড়ে

Like
474525369_1074216644505260_833710345513391369_n.jpg
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
Co-editor: Dr. Oishimaya Sen Nag

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page