top of page
..

গাড়োয়ালের ডায়েরি (পর্ব ৪): রুদ্রনাথের পথে প্রকৃতির রুদ্ররূপ

চলছে উত্তরাখন্ডের গাড়োয়াল হিমালয়ের ওপর ধারাবাহিক ভ্রমণ-কথা। স্মৃতি থেকে কলম ধরলেন সুমন্ত ভট্টাচার্য্য


রুদ্রনাথ থেকে দেখা সূর্যাস্ত। জ্বল জ্বল করছে ত্রিশূল।

তখন ১৪৫০০ ফুট ওপরে নাওলা পাসের ওপর সার দিয়ে বসে আমরা। আমরা তিনজন আর আমাদের দুই পথ প্রদর্শক কাম পোর্টার শিশপাল সিং আর তাজবর সিং। বসে থেকে দেখছি নীচের ঘন জঙ্গলে কেমন মেঘ জমেছে স্তরে স্তরে। আজ এখান থেকে খাড়া চড়াই পথে নেমে যাব অনসূয়ায়। আজ সকালে যখন রুদ্রনাথ থেকে রওনা দিয়েছি ফেরার জন্য, রোদ ঝলমলে হিমালয় প্রকৃতির বুকে একটু একটু করে মেঘের ছায়া নেমে এসেছে। অথচ কাল ঠিক এই সময়ে পানারের সবুজ গালিচার মত বুগিয়াল ছেড়ে যখন পিতৃধারের শীর্ষে পৌঁছেছিলাম,তখন ১৮০ ডিগ্রী ঘিরে একটার পর একটা শৃঙ্গ নিজেদের রূপ মেলে ধরেছিল আমাদের সামনে। ক্ষুদ্র মনুষ্যপ্রাণ। গাড়োয়াল হিমালয়ের অলৌকিক সৌন্দর্যে হারিয়েছে ভাষা। নন্দাদেবী, ত্রিশূল, নন্দাঘুন্টি, মুকুট, হাতি-ঘোড়া পর্বত...আর পশ্চিমে ওই চৌখাম্বার মাথাটুকু দেখতে পেয়েছিলাম। তারপর রুদ্রনাথ পর্যন্ত গোটা পথেই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চলেছে ধ্যানগম্ভীর শৃঙ্গরাজি।

পানার বুগিয়াল

এত সামনেই আছে তারা এই নওলা পাসের। অথচ কুহকিনী মেঘেদের মায়াজালে আজ বিদায়বেলায় তাদের দেখা নেই। “চলো ভাইয়া। আভি তো উতরনা পড়েগা, নেহিতো বারিশ আ জায়েগা তো ইস জঙ্গল কি রাস্তে মে মুশকিল মে পড়না হোগা”। শিশপাল সিং এর গলা গম্ভীর। ‘জয় বাবা রুদ্রনাথ’ নাম নিয়ে সবাই গা-ঝারা দিলাম। এখন প্রায় ২০ কিলোমিটার চলতে হবে ঘন জঙ্গলে। আজকাল বেশি লোক এইপথে আসে না। আমাদের উদ্দেশ্য ফেরার পথে অনসূয়া গ্রামে প্রাচীন অনসূয়া দেবীর মন্দির দেখে তারপর আরো ৬ কিলোমিটার গিয়ে মন্ডলে পৌঁছানো। এককালের মন্ডলচটি।কেদার থেকে বদ্রী যাবার পথের বিরতি হত এখানে। এখন মোটরপাড়ি এইসব সুন্দর সুন্দর জায়গাকে পথের পাশে অবহেলায় ফেলে ছুটে যায় গন্তব্যে। অদেখা থেকে যায় কত না-দেখা। সেই মন্ডলেই অপেক্ষা করে আছে আমাদের বাহন আর ভগত সিং এর হোটেলে আমাদের বাকি মালপত্তর।

১৬ হাজার ফুট ওপরে নওলা পাসে।

এতসব গাছপালার মধ্যে দিয়ে নামছি। রডোডেনড্রনগুলো চিনতে পারছি। বাকি সব গাছের ব্যাপারে অজ্ঞ। ওই লাল ফলগুলোই বা কি জায়গায় জায়গায়! এপথে তেমন লোক চলাচল নেই বোঝা যাচ্ছে। ঘন ঝোপে, ডালে পথ জায়গায় জায়গায় অবরুদ্ধ। আগে আগে পথ করে চলেছেন শিশপালজি আর তাজবর সিং। ওদের গতির সাথে তাল মেলানো মুস্কিল। দৌড়তে দৌড়তে ওরা থামছে কোন পাথরের ওপর। ছুট্টার আগুনে একটু সুখটান আর আমাদের জন্য অপেক্ষা। পথে নামতে নামতে মনে ভেসে উঠছে কাল সন্ধ্যায় রুদ্রনাথ মন্দির চত্বর থেকে দেখা স্বর্গীয় সূর্যোদয়ের জলছবি। তখন সবে পূজাপাঠে বসেছেন পূজারীজি হরিশ ভাট।অক্ষয় তৃতীয়া থেকে কার্তিক সংক্রান্তি পর্যন্ত্য থাকেন রুদ্রনাথের গুহামন্দিরে। তারপরে নেমে যান রুদ্রনাথজিকে সঙ্গে নিয়ে গোপেশ্বরে। শীতের যে সময়টায় বরফে বরফে ঢেকে যায় পান্ডবদের স্মৃতিধন্য রুদ্রনাথ, তখন পঞ্চকেদারের অন্যতম রুদ্রনাথের পুজোপাঠ চলে চামোলি জেলার সদর শহর গোপেশ্বরে। একদিকে নন্দাদেবী, ত্রিশূলের শীর্ষদেশ রাঙিয়ে দিয়ে সূর্যদেব বিদায় নিচ্ছেন। ধূপ-ধূনোর গন্ধ আর কাসর-ঘন্টা, মন্ত্রোচ্চারণের শব্দে জেগে উঠছে অন্য এক হিমালয়।

রুদ্রনাথের গুহামন্দির।

যে হিমালয় যেন কত শতাব্দী ধরে, কত যুগের পার থেকে ভারতের আত্মাকে এভাবেই জাগিয়ে রেখেছে। ধন্য আমরা, এমন এক সন্ধ্যায় এই আকাশের নীচে দাড়িয়ে।

“ও দেখিয়ে দাদা, হিরণ..!” ভাবনায় ছেদ পড়ল তাজবর সিংদের চিৎকারে। ওই দূরে নীচে একটা বুগিয়াল। ওখানে চড়ে বেড়াচ্ছে বেশ কিছু ভরাল। হিমালয়ের গভীরে এদের চলাচল। ওই বুগিয়ালেই নাকি আমরা নেমে যাব। কি আশ্চর্য! আমাদের গলা পেয়েছে ওরা এত উপর থেকেও। হুড়মুড়িয়ে পালালো আড়ালে। রাজত্ব তো ওদেরই। সভ্যতার দর্পে দুর্বীনিত মানুষ আমরা সেখানে এসে দাপাদাপি করে বিঘ্ন ঘটাচ্ছি ওদের জীবনে।

মেঘ ঘিরে ধরেছে চারপাশে এবার। কথায় কথায় খেয়াল হয়নি কারুর। ওই পাশের পাহাড়টাও আর দেখা যাচ্ছে না। নেমে চল দ্রুত। কিন্তু একটা-দু’টো করে ফোঁটা পড়তে শুরু করে দিল তো যে...ঝটাপট বার কর রেনকোট। কিন্তু তাজবর সিংরা কি করবে! ওদের তো সম্বল দুটো লম্বা ছাতা। তা দিয়ে এই খাড়া পথে নামবে কি করে। “চলিয়ে দাদা, কোই বাত নেহি....হাম তো উতর জায়েঙ্গে”। তা তো বুঝলাম...কিন্তু কতক্ষণ! বেশিক্ষণ যে না, তা প্রকৃতি বুঝিয়ে দিল। একটু পড়েই টিপটিপ ফোঁটাগুলো ঝমঝমিয়ে নেমে এল। না ওদের তো এভাবে যেতে দেওয়া যায় না। আমার রুকস্যাকে ছিল দু’টো পলিথিন। এর আগে ফালুট ট্রেক করতে গিয়ে এস এস বি ক্যাম্পের জওয়ানদের থেকে পেয়েছিলাম। সেবারও খারাপ প্রকৃতির মধ্যে পড়েছিলাম সুদূর পাহাড়চূড়ায়। কিন্তু মানুষ সদয় ছিল না সেবার। অসহায় অবস্হার সুযোগ নিয়ে কিভাবে বেকায়দায় ফেলতে পারে ট্রেকিং এর নামে ব্যবসা চালানো কিছু মানুষ সেখানে দেখেছিলাম সিঙ্গলীলায়।সেনা জওয়ানদের দেওয়া এই দু’টো পলিথিন শিটে মাথা-মুড়ো ঢেকে কোনক্রমে বেড়িয়ে এসেছিলাম ‘বধ্যভূমি’ থেকে! তা সেই দু’টোই এবার কাজে লাগল আমাদের দুই সঙ্গীর। তাদের পিঠের বোঝা এবং তারা নিজেরাও ঢাকা পড়লেন তার নীচে। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে সর্পিল ও সঙ্কীর্ণ পথে আমাদের অবরোহণ আবার আরম্ভ হল। একটা একটা পা-ফেলে, গাছের শিকড়-ডাল-পাতা যা পাওয়া যায় ধরে আপ্রাণ সোজা পথে থাকার চেষ্টা। তাজবর সিংদের আমরা বললাম- বেশি আগে এগিয়ে যেওনা এই অবস্হায়। ঘন জঙ্গলে ভুল পথে নেমে গেলে আজ আর বেঁচে ফেরা হবে না। “আরে তুম লোগ তো হামারে ভাই জ্যায়সা হো। কোই চিন্তা মত করো”। কোথায় পাবেন এমন আশ্বাস! সম্ভব হয়ত একমাত্র উত্তরাখন্ডের পাহাড়ে। কতই বা তারা পাবে আমাদের থেকে এই সফর শেষে। তবু “যাত্রী”দে’র সঠিক পথে পৌঁছে দেওয়াই তাদের যুগ যুগ ধরে ধর্ম‍! এই হল আমার দেশ! আজও ভাবলে ভালোবাসায়, আবেগে গলা ভারী হয়ে আসে।

পথ গেছে রুদ্রনাথে

চলতে চলতে প্রথম আছাড়টা খেল এক সঙ্গী। আমার সামনেই। পথের ওপর দিয়ে এখানে-ওখানে জল বয়ে যাচ্ছে। মাটি কাদা-কাদা, পাথর পিচ্ছিল। আমাদের কারুর জুতোই বর্ষায় পাহাড়ি পথে যাওয়ার মত নয়। ভাগ্য ভালো ওর চোট লাগেনি। এবার আমাদের তিনজনের মধ্যে আমি সামনে সামনে চলতে লাগালাম। পিছনে অমিতদা আসছে স্টেডি পায়ে। অদ্ভুত মানুষ। ঘরে থাকলে বছরভর নানারকম অসুখে ভোগে। অথচ গাড়োয়ালে এলে ও নাকি সবার থেকে ফিট! তাই শুনেছিলাম আসার আগে। এবার দেখলামও। ওর চলার গতি দেখে রুদ্রনাথ ওঠার সময় শিশপাল সিংরাও অবাক। ওরাও তো অত জোর উঠতে পারে না টানা! হিমালয়ের মহিমা। এই রে, দেখতে দেখতে আমিও খেলাম হোঁচোট্। পুরো রেন-কোটটা কাদায় মাখামাখি হল। এমনিতেও এই বৃষ্টিতে ডাকব্যাগের রেনকোট আমাদের বাঁচাতে পারেনি (তখনও কেচুয়া বা ডেকাথেলনের সাথে পরিচয় হয়নি)। ভিতরের যা কিছু ছিল উলিকট-টুলিকট সব গেছে ভিজে অনেকক্ষণ। জুতো-মোজাও ভিজে চপচপে। উঠে পড়ে সাবধান পায়ে আবার চলতে শুরু করলাম। বৃষ্টি টানাই হয়ে যাচ্ছে। আমরাও মাঝে-মধ্যেই আছাড় খাচ্ছি পথে। একদিকে পাহাড়ের দেওয়াল, ওপাশে খাদ, জঙ্গল! এভাবে নামতে নামতে একসময় গন্তব্য কাছে এসে গেল। মাঝে একটা বুগিয়ালে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিয়েছিলাম মেষপালকদের ফেলে যাওয়া ছাউনিতে। শীত পড়ছে। সবাই নেমে গেছে তারা ভেড়ার পাল নিয়ে।

ওই এসে গেল অনুসূয়া। কিন্তু , একি! গ্রামের সীমার বাইরে যে বালখিল্য গঙ্গা নদী, তাতে যে খরাস্রোত এখন। আচমকা বৃষ্টির জলে তা প্রলয়নাচন নাচতে নাচতে নেমে চলেছে বন-জঙ্গল ভেদ করে। এর তো প্রস্তুতি ছিল না। আজ কত পরীক্ষা দিতে হবে এ পথে! পার হওয়ার সেতু বলতে তো দেখছি একটা মাত্র গাছের ডাল এপার-ওপার করে রাখা। ওই ঠান্ডাতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল কি! প্রথমে শিশপাল সিংরা আমাদের স্যাক নিয়ে পেরিয়ে গেলেন। ভাইয়া, এভাবেই দু’হাতে ডাল ধরে হামাগুড়ি দিয়ে আসুন। প্রবোধ দেয় ওপার থেকে। অমিতদা জয় বাবা রুদ্রনাথ নাম নিয়ে গুটিগুটি এগিয়ে গেলো। চারপায়ে ধীরে ধীরে পৌঁছে গেল ওপারে। এবার আমি। পেরচ্ছি দু’হাতে ডাল ধরে। হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে। রুদ্রনাথজিকে ডেকে চলেছি । জলের আওয়াজে ভালো করে শোনা যাচ্ছে না ওদিক থেকে শিশপাল সিং কি নির্দেশ দিচ্ছেন। এভাবেই এগোতে এগোতে একসময় মাটি ছুঁলাম। টেনে নিলেন শিশপাল সিং। এবার মামার পালা। আরও কিছু রুদ্ধশ্বাস মূহুর্ত। একসময়ে তিনজনেই এইপাড়ে চলে এলাম। ফাঁড়া কাটল যাত্রাপথের। ক্লান্ত, অবসন্ন, ভিজে চপচপে দেহটা যেন টেনে নিয়ে চলেছি অনুসূয়া গ্রামের দিকে। জঙ্গল শেষে চোখে পড়ল গ্রাম। ওই তো সবুজের মধ্যে মাথা তুলে দাড়িয়ে অনুসূয়া মন্দির। গাড়োয়ালের মানুষের কাছে বড় জীবন্ত, বড়ই কাছের এই মন্দির। পুরাণ অনুযায়ী, সপ্তঋষির অন্যতম অত্রি মুনির পত্নী দেবী অনসূয়ার সতীত্বের সুনাম মর্ত্যলোক ছাড়িয়ে পৌঁছেছিল স্বর্গেও। দেবতাদেরও তো ঈর্ষা থাকে। অনসূয়ার সুনামে ঈর্ষান্বিত হলেন দেবী পার্বতী, লক্ষী আর সরস্বতী। তারা তাদের স্বামী মহাদেব, বিষ্ণু ও ব্রহ্মাকে পাঠালেন অনসূয়ার সতীত্বের পরীক্ষা নিতে। তিন দেব ছদ্মবেশে এসে অনসূয়ার কাছে খেতে চাইলেন। অতিথিবৎসল অনসূয়া তাদের আপ্যায়ন করলেন। কিন্তু অতিথিরা শর্ত দিলেন তারা একটা শর্তেই আতিথ্য গ্রহণ করবেন-অনসূয়াকে কোলে বসিয়ে তাদের স্তন্যপান করাতে হবে। অনসূয়া দিব্যদৃষ্টিতে বুঝতে পেরেছিলেন এরা হলেন তিন দেব। জগতের রক্ষাকর্তা। তিনি বললেন, তাঁর সেভাবে দিতে আপত্তি নেই-যদি অতিথিরা তার সন্তানের মত ছোট শিশু হয়ে যান। দেবতারা রাজি হলেন। তাদের ছোট শিশু বানিয়ে দিলেন অত্রিমুনি কমন্ডুলের জলের ছেঁটায়। ঘরে রেখে দিলেন তাদের। থাকলেন তাদের সন্তান হয়ে। দিনের পর দিন। ফলে স্বর্গে তো আর ফেরা হয়না তিন দেবাদিদেবের। তাদের স্ত্রী’রা পড়লেন সমস্যায়। তারা এলেন অনসূয়ার কাছে নিজেদের স্বামীদের ফিরিয়ে দেওয়ার প্রার্থনা নিয়ে। দেবী পার্বতী, লক্ষী ও সরস্বতীর সম্মানে অনসূয়া ফিরিয়ে দিলেন তাদের স্বামীদের স্বমহিমায়। তিনি ও তাঁর স্বামী অত্রি তাদেরকে নিজেদের সন্তান হিসাবে পাওয়ার বাসনা প্রকাশ করলেন। শিব, বিষ্ণু ও ব্রহ্মা জন্ম নিলেন তাঁদের ঘরে ঋষি দুর্বাশা, দত্তাত্রেয় ও চন্দ্রদেবরূপে। দেবী অনুসূয়া পূজা পেতে লাগলেন সতী অনসূয়ারূপে। আজও ডিসেম্বরে দত্তাত্রেয় জন্মোৎসব এখানে ধূমধামসহ পালিত হয়। দূর দূর থেকে আসেন যাত্রীরা। এতদিন থেকে গল্প শুনে আসা সেই অনুসূয়া মন্দিরের সামনে এখন আমরা।

অনসূয়া মন্দির







একসময় কেদারবদ্রীর পথ হতে বিস্তীর্ণ বনের মধ্যে দিয়ে যাত্রা করে এখানে এসে পৌঁছেছিলেন বাংলার হিমালয়-পথিক উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। মনে পড়ে তার সময়কার তরুণ পূজারি কৃষ্ণমনির গল্প। ভূমিকম্পে প্রাচীন মন্দির ধ্বংস হওয়ার পর ১৯৪৫ সালে আবার তৈরি হয় নতুন করে। এই গ্রামে রয়েছে অত্রমুনির গুহাও। শুনেছি সে পথ দুর্গম। জানিনা এই দুর্যোগে আমাদের কপালে তার দর্শন আছে কিনা। কিন্তু আগে চাই আশ্রয়। শিশপাল সিংদের পায়ে পায়ে পৌঁছে যাই তিওয়ারি লজে। মন্দিরের একটু দূরে। দো’তলায় ঘর। গিয়ে সবাই ওই ভেজা শরীরেই বিছানায় হাত-পা ছেড়ে দিই। একটু পরে চা আসে নীচ থেকে।একটু চাঙ্গা হয় অবসন্ন শরীর।ঘরে জ্বলছে টিমটিমে ব্যাটারির আলো। আজকের নিদারুণ পথশ্রমে মনের তূড়ীয়ভাবের সাথে শরীর কিছুতেই আর তাল মেলাতে পারছিল না। বাইরে তখনও বারিধারা। একে একে আমাদের পোষাক পরিবর্তন করা হল। বারান্দায় দাড়িয়ে দেখছি দূর পাহাড়ের পথ। যে পথ আমরা ফেলে এসেছি আজ, অবাক বিস্ময়ে তার দিকেই তাকিয়ে লজের বারান্দা থেকে। শিশপালরা বললেন, আজ নাকি বরফ পড়া শুরু হয়ে গেছে ওপরে রুদ্রনাথে! ঘরে একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে ব্যাটারিতে। শুয়ে শুয়ে যাত্রার স্মৃতিরোমন্থন করি আমরা। সন্ধ্যার কিছু পরে নীচের রান্নাঘর থেকে খাওয়ার ডাক আসে। খিচুড়ি আর আলুভাজায় আজকের ভোজ। আহা, সে কি বলব! শীতের রাতে রান্নাঘরের উনুনের পাশে বসে আগুন পোহাতে পোহাতে সেই স্বর্গীয় সুখাদ্য। যত্ন করে পরিবেশন করে দিচ্ছিলেন আমাদের গাইডরা। এদের আন্তরিকতা আজ এই কৃত্রিমতার যুগেও হিমালয় প্রকৃতির মত উদার, অনাবিল। একসময় এই গ্রামে খুব ভালো ঘি-মাখন-মিষ্টির চল ছিল। আজও গো-পালন হয়। কিন্তু গ্রামের লোকসংখ্যা এখন তলানিতে ঠেকেছে। রোজগারের অভাব গ্রামের মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে ইট-কাঠের নির্মম শহরে। দু:খ করছিলেন লজের ম্যানেজার। তাদের থেকে গাড়োয়ালের গ্রামের মানুষের রোজনামচা, জীবন সংগ্রামের উপাখ্যান শুনছিলাম । উমাপ্রসাদবাবুর পরিচিত সেই কৃষ্ণমনি এখন বৃদ্ধ। থাকেন সেই দেরাদুনে নিজের ছেলেদের কাছে।

সেই তিওয়ারি লজ।

রাতে শুয়ে এসবই ভাবছিলাম। চোখে ঘুম লেগে আসছে। দূরে মন্দিরে কেউ বাজালো ঘন্টা। হিমালয়ের চূড়ার নীচে, বনের অন্তরালে, প্রাচীন মন্দির আজও জানান দেয় গাড়োয়াল আছে তার স্বমহিমায় তার মানুষদের নিয়ে। প্রশ্ন ছুড়ে দেয় বাকি পৃথিবীর দিকে, যে হিমালয়, যে উত্তরাখন্ড ভারতীয় সভ্যতাকে পুষ্ট করেছে যুগ-যুগান্ত ধরে, তাকে বাঁচিয়ে রাখার মত সম্পদ, দূরদৃষ্টি- দেশের মানুষের হৃদয়ে আছে কী!



লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় চিকিৎসক। প্রকৃতি ও অরণ্যপ্রেমী। 'বনেপাহাড়ে' ওয়েবজিনের সম্পাদনার দায়িত্বে।



ছবি: লেখক








186 views0 comments

Comments


Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page