top of page
..

ক্ল্যারিয়ন ক্লিপারটন জোন, তার জীববৈচিত্র্য এবং আসন্ন বিপদ

আধুনিক পৃথিবীতে ব্যাটারিচালিত যন্ত্রই নাকি ভবিষ্যৎ। তা নাকি পরিবেশবান্ধব। তাই দিকে দিকে বাড়ছে তার চাহিদা। কিন্তু এই চাহিদার আড়ালে তছনছ হতে চলেছে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে অবস্থিত আশ্চর্য জীববৈচিত্রের বিচিত্র এক ভান্ডার। তাই নিয়ে কলম ধরলেন ডা: রুদ্রজিৎ পাল


ক্ল্যারিয়ন ক্লিপারটন জোনে একটি ক্যামেরা মুখোমুখি sponge Hyalonema ও স্টারফিশের। ছবি: wikimedia commons/ Geomar Bilddatenbank

প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তরভাগে একটি পঁয়তাল্লিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার অংশের নাম ক্ল্যারিয়ন ক্লিপারটন জোন। এই বিশাল জলরাশির নীচে রয়েছে এক সম্পূর্ণ জগৎঃ সমুদ্রের সমতলভূমি,

পাহাড়, উপত্যকা ইত্যাদি---সবটাই বারিধির অন্তঃস্থলে। এই বিশাল এলাকা কোনও দেশের

সম্পত্তি নয়, ইন্টারন্যাশান্যাল সীবেড অথরিটির অধীনে। এই এলাকাটি একটি ফ্র্যাকচার জোন, অর্থাৎ, এখানে, জলের নীচে রয়েছে উঁচু উঁচু পাহাড় এবং তাদের মাঝখানে গভীর খাদ---শত শত মাইল ধরে। প্রশান্ত এবং অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে এরকম বেশ কিছু ফ্র্যাকচার জোনের কথা আমরা জানি। সব মহাসাগরেই এরকম এলাকা রয়েছে। আমাদের দেশের দক্ষিণে, ভারত মহাসাগরের সমুদ্রতল নিয়ে গবেষণা খুব কম। ফলে, এখানে এরকম এলাকা থাকলেও তার স্বরূপ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা সম্ভব নয়।



এই ক্ল্যারিয়ন ক্লিপারটন জোন এক প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য বলা যায়। এমনিতে, এটা আপনারা সবাই নিশ্চয়ই জানেন যে, সমুদ্রের জলের নীচে যে জীবজগৎ রয়েছে, তার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই এখনও আমাদের অচেনা। মানে এক বিপুল পরিমাণ প্রাণী জগত এখনও মানুষের চোখের আড়ালে। তার মধ্যে এই ক্ল্যারিয়ন ক্লিপারটন জোন হল নতুন আবিষ্কারের খনি। শুধু গত দশ বছরেই এখানে প্রচুর নতুন প্রাণী আবিষ্কার হয়েছে। এবং আরও অনেক সমুদ্রের জলের নীচে আবিষ্কারের অপেক্ষায়। পাহাড় বা জঙ্গলের নতুন প্রাণীর কথা এই ওয়েবজিনে আপনারা প্রায়ই শোনেন। কিন্তু সমুদ্রের নীচের প্রাণীজগৎ নিয়ে আমাদের দেশেই আলোচনা খুব কম। এর একটা কারণ হল, আমাদের দেশে সেরকম গভীরসমুদ্র গবেষণা প্রায় নেই। আজকে আসুন, এই ক্ল্যারিয়ন ক্লিপারটন জোনের জৈববৈচিত্র্য নিয়ে কিছু ঝলক দেখা যাক। এই আলোচনার একটা কারণ রয়েছে। এই ক্ল্যারিয়ন ক্লিপারটন জোনের জীবজগৎ এক অভূতপূর্ব বিপদের মুখোমুখি। সেই বিপদ নিয়ে আলোচনা রইল এই প্রবন্ধের শেষ অংশে।

২০২৩ সালে 'কারেন্ট বায়োলজি' জার্নালে লন্ডনের ম্যুরিয়েল র‍্যাবোঁ এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিকদের একটি বিখ্যাত পেপার প্রকাশিত হয়। তাঁরা এই ক্ল্যারিয়ন ক্লিপারটন জোনের জীবজগতের একটি আংশিক খতিয়ান দিয়েছেন। এতে দেখা যাচ্ছে যে, এখন অবধি এই সামুদ্রিক এলাকায় প্রায় ৫১০০ স্পিসিসের খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৮৮-৯২% নতুন স্পিসিস। মানে বুঝতে পারছেন? আমরা যা জানি, তার হয়ত একশো গুণ অজানা প্রাণী রয়েছে শুধু এই সমুদ্রখণ্ডের মধ্যেই। কিছু এরকম নতুন প্রাণীর ছবি এবং পরিচয় নীচে দেওয়া হল।



এর নাম হল গামি স্কুইরেল। অর্থাৎ, গামি (Gummy: a type of jelly lozenge) লজেন্স দিয়ে বানানো কাঠবিড়ালি! দেখতে ওরকম নরম লজেন্সের মত হওয়ায় বৈজ্ঞানিকরা এরকম নামকরণ করেছেন। এটি পাওয়া যায় সমুদ্রের নীচে প্রায় পাঁচ হাজার মিটার গভীরে। এগুলি হল এক ধরণের সী কিউকাম্বার। অর্থাৎ, একাইনোডার্ম গোষ্ঠীর প্রাণী।


Sea squirt

এই ভিনগ্রহীদের মত দেখতে জীবটি হল এক ধরণের টিউনিকেট (Tunicate)। এগুলি হল অমেরুদণ্ডী প্রাণী। সী স্কুইয়ার্ট (Sea squirt) জাতীয় প্রাণীরা এই গোত্রের মধ্যে পড়ে। এই প্রাণীদের পাওয়া গেছে ৪০০০ থেকে ৬০০০ মিটার গভীরে।


Enypniastes eximia ছবি: flickr/CC BY-SA 4.0

এটি আরেক ধরণের সী কিউকাম্বার। এদের শরীর, ছবি দেখেই বুঝতে পারছেন, অংশত স্বচ্ছ। এরা একদম গভীরতম সমুদ্রের মেঝের ওপর থাকে এবং একটু কম গভীরতায় বা বেশি তাপমাত্রায় এলেই এদের এই স্বচ্ছ শরীরের মেটাবলিজম বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং, সমুদ্রের এই বিশেষ অতি গভীর এলাকা ছাড়া এরা বাঁচতেই পারবে না। একাইনোডার্ম গোত্রের এই প্রাণীদের দেখলে মনে হয় যেন মিউজিয়ামে রাখা প্লাস্টিকের স্পেসিমেন!!




এটা সমুদ্রের অন্ধকারে থাকা একটি নতুন প্রজাতির নরম কোরাল বা প্রবাল। এর নাম হল ক্রাইসোগর্জিয়া (Chrysogorgia)। এদের কলোনির বড় ছবি দেখলে মনে হবে যেন একটা ডালপালাওয়ালা গাছ। এই কোরাল হালকা কমলা বা সাদা রঙের হতে পারে।


এর পর আমরা দেখব স্টার ফিশ গোত্রের একটি প্রাণী। এর নাম ডাইটেস্টার (Dytaster)। এরা সমুদ্রের নীচে সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্যে থাকে।




এরপরের যে প্রাণীটি, তাকে দেখলে মনে হবে যেন সমুদ্রের নীচে টিউলিপ ফুল ফুটে আছে। এটি এক ধরণের স্পঞ্জ। এঁকে বলা হয় হায়ালোনেমা। এরা ৪৫০০---৫০০০ মিটার গভীরে সমুদ্রের নীচে বালি বা পাথরের ওপর “ফুটে” থাকে।




নীচের প্রাণীটি দেখে মনে হবে যেন সমুদ্রের জলের নীচে এক গুচ্ছ ঘাস হয়ে আছে। কিন্তু এটা ঘাস নয়, স্পিরুলারিয়া গোত্রের একটি প্রাণী!! অর্থাৎ, Cnidaria। সী অ্যানেমোন এই গোষ্ঠীর মধ্যেই পড়ে। যদিও, ছবিতে যে প্রাণীটি দেখা যাচ্ছে, সেটি নতুন জাতের।













আর সব শেষে দেখাচ্ছি আরেকটি অপূর্ব প্রাণীর ছবি। এর নাম ফেদার স্টার।



যে সব ছবি এখানে রয়েছে, এদের বেশিরভাগ বিজ্ঞানীদের কাছে একদম নতুন। এদের চরিত্র, সমুদ্রের খাদ্য শৃঙ্খল বা জৈবচক্রে এদের গুরুত্ব---কিছুই এখনও জানা নেই। জানতে হয়ত লেগে যাবে আরও পঞ্চাশ বছর। কিন্তু মুশকিল হল, সব আবিষ্কৃত এইসব প্রাণী ততদিন হয়ত আর বাঁচবে না। তার কারণ কী? কেন অচিরেই দুএকটা জার্নালের ছবি ছাড়া এই প্রাণী পৃথিবী থেকে মুছে যেতে বসেছে? আসুন, তার কারণ এবার দেখা যাক।


তেল, খনিজ ধাতু, জল---- পৃথিবীর বুক থেকে মানুষ তুলে আনেনি, এরকম দ্রব্য নেই। কিছুটা প্রয়োজনে আর কিছুটা লোভের বশে মানুষ পৃথিবীর কুবেরের ভাণ্ডার থেকে সম্পদ আহরণ করেই চলেছে। কিন্তু শুধু মাটির নীচের রাজকোষ থেকে নিলে আর চলছে না। এবার পরিকল্পনা হচ্ছে সমুদ্রের নীচের অদেখা সম্পদ দখলের।

পলিমেটালিক নোডিউল। শুনলে মনে হবে ক্লাস সেভেনের সায়েন্স প্রোজেক্টের কোনও বস্তু বা মার্ভেল কমিক্সের ভিলেনের গোপন অস্ত্র। কিন্তু তা নয়। খনিজ ধাতুর ব্যবসায় এই পলিমেটালিক নোডিউল হল গোল্ড রাশের সময়ের ক্যালিফোর্নিয়ার সোনার খনির মত। অভূতপূর্ব সম্পদের হাতছানি, রাশি রাশি যকের ধনের সম্ভাবনা। সেই ১৮৫০ সালের ক্যালিফোর্নিয়ার গোল্ড রাশের সময়ে যেমন সারা পৃথিবী থেকে লাখ লাখ লোক এর লোভে ছুটে এসেছিল, ঠিক সেরকম আজকের দিনে এই নতুন গোল্ড রাশের জন্য শত শত কোম্পানি সমুদ্রের নীচে নামতে তৈরি।


Plymetallic nodules of Manganese

এই পলিমেটালিক নোডিউল হল সমুদ্রের জলের নীচে ছড়িয়ে থাকা কিছু পাথরের খণ্ড। সম্প্রতি আবিষ্কার হয়েছে যে, এর মধ্যে রয়েছে লোহা, তামা, নিকেল, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ এবং রেয়ার আর্থ ধাতু। এবং এদের পাওয়ার জন্য কোনও মাটি খুঁড়তে হবে না, পাথর ভাঙতে হবে না। এরা ছড়িয়ে আছে সমুদ্রের বুকে। শুধু তুলে নেওয়ার অপেক্ষা।

কিন্তু কেন লাগবে এইসব ধাতু? আধুনিক পৃথিবীর প্রযুক্তি যে দিকে ছুটছে, তাতে দুটি জিনিসের চাহিদা আগামী দশ বা বিশ বছরে ভয়ঙ্করভাবে বাড়বে--- রিচার্জেবল ব্যাটারি এবং টাচ স্ক্রীন। সব দেশ ফসিল ফুয়েলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ব্যাটারি চালিত গাড়ি, মেশিন ইত্যাদির দিকে ঝুঁকছে। সেই ব্যাটারি চালিত যন্ত্রের জন্যই লাগবে লিথিয়ামের মত ধাতু। আগামী পঞ্চাশ বছরে যে “এনার্জি ট্র্যাঞ্জিশান”

হবে পৃথিবী জুড়ে, সেখানেই এইসব ধাতুর চাহিদা বাড়বে। এবার পৃথিবীর স্থল্ভাগে এরকম ধাতুর

ভাণ্ডার খুব বেশি নেই। কিন্তু সমুদ্রের নীচে রয়েছে অফুরন্ত ভাণ্ডার। এবং আরেকটা সুবিধা হল- সুমদ্র কোনও দেশের একার সম্পত্তি নয়। সেই ক্যালিফোর্নিয়ার গোল্ড রাশের মত, যে খুঁজে পাবে, এই সম্পদ তার। ফলে প্রচুর কোম্পানি তৈরি হয়ে রয়েছে এই পলিমেটালিক নোডিউল তুলে এনে ব্যবসা করার জন্য।


Green energy আদৌ কতটা Green?

এই পলিমেটালিক নোডিউল তুলে আনতে ইতিমধ্যেই বানানো হয়ে গেছে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। এরা

সমুদ্রের নীচের সমতলভূমি বরাবর চারিদিকে ছড়িয়ে যাবে এবং বালুকাবেলা থেকে ঝিনুক কুড়ানোর মত করে এইসব ধাতুর খণ্ড তুলে নিয়ে আসবে জলের উপর। কিন্তু সেখানেই যত সমস্যা। শুধু কি আর ধাতুর খণ্ড তুলেই এই মেশিন থেমে যাবে? এই প্রক্রিয়ায় collateral damage হবে এই সমুদ্রের তলে থাকা স্টার ফিশ, স্পঞ্জ, ফেদার স্টার, সী কিউকাম্বার ইত্যাদি। একদম অন্ধকারে, বালি বা পাথরের সাথে মিশে থাকা এইসব প্রাণীর কোমল দেহ অচিরেই ছিন্নভিন্ন হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে। হয়ত মানুষের অদেখা হাজার হাজার স্পিসিস এভাবেই হারিয়ে যাবে।


Deep sea mining. ছবি: flickr


প্রশ্ন হল, কত পরিমাণে পলিমেটালিক নোডিউল রয়েছে সমুদ্রের নীচে? সত্যি বলতে, সমুদ্রের নীচের জগৎ কিন্তু আমাদের এখনও অচেনা। কটা আর এক্সপিডিশান হয়েছে? তবে শুধু ক্ল্যারিয়ন ক্লিপারটন জোনেই অনুমান করা হয় যে লক্ষ কোটি এরকম পলিমেটালিক নোডিউল আছে। তার মানে, পৃথিবীর সমস্ত স্থলভাগের সমস্ত খনিতে যা বিরল ধাতু রয়েছে, তার থেকেও বেশি! কেন যে তাবড় তাবড় কোম্পানি এই মাইনিং রাইটস্‌ নেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে, সেটা বুঝতে অসুবিধা নেই।

এই সব পলিমেটালিক নোডিউল অনেক রকম দুর্লভ সামুদ্রিক প্রাণীর বাসা। সী স্টারের মত প্রাণীরা হয়ত সারা জীবন এদের সাথে আটকেই কাটিয়ে দেয়। কিছু অক্টোপাস এদের চারপাশে ডিম পাড়ে। কিন্তু যখন যন্ত্রের সাহায্যে এইসব পলিমেটালিক নোডিউল এক নিমেষে তুলে নেওয়া হবে, তখন এই লক্ষ বছরের বাস্তুতন্ত্র এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাবে।

মুশকিল হল, এই সর্বনাশ আটকাবে কে? একদিকে আমরা বলছি যে ক্লীন এনার্জি চাই। সেটার

জন্য লিথিয়াম লাগবে। আবার অন্যদিকে সেই লিথিয়াম পাওয়ার জন্য, আর শুধু পাওয়ার জন্য

নয়, তাড়াতাড়ি প্রচুর পরিমাণে পাওয়ার জন্য, সমুদ্রের নীচের ভাণ্ডার দখল করতে হবে। আর

কিছু কিছু স্বপক্ষের যুক্তিও রয়েছে। স্থলভাগে খনিতে যে শিশুশ্রমিক ব্যবহার হয়, সেটা আর

দরকার হবে না, প্রশান্ত মহাসাগরের দূরবর্তী দ্বীপরাষ্ট্রগুলির অর্থনীতি এর ফলে স্বনির্ভর হতে

পারবে। এগুলো ফেলে দেওয়ার মত নয়। তাহলে উপায় কী?

উত্তরটা আমার জানা নেই। পাঠকরা ভাবুন।


লেখক পরিচিতি: ডা: রুদ্রজিৎ পাল একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও লেখক।

Comments


Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page