top of page

ছত্তিসগড়ের হাসদেও অরণ্যে কয়লাখনির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আদিবাসীরা

..

জীববৈচিত্রের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ঘোষিত হলেও ছত্তিসগড়ের হাসদেও অরণ্যে নতুন করে কয়লাখনি খনন করার অনুমতি দিয়েছে ছত্তিসগড় সরকার আদানি গোষ্ঠীকে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তা ঠেকিয়ে রেখেছেন ওখানকার আদিবাসী মানুষ। এগিয়ে এসেছেন কবীরপন্হী সম্প্রদায় থেকে National Tiger Conservation Authority। বিশ্ব উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের এই ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আলাদা তাৎপর্য পেয়েছে এই আন্দোলন। লিখছেন অলোক প্রকাশ পুতুল


ঐতিহাসিকভাবে নজিরবিহীন দাবাদহ এই বছরে ভারতের অনেক জীবনকে প্রভাবিত করেছে। উঠে আসছে এই প্রসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কথাও।গ্রীষ্মের সময়ে মানুষকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হলেও ঠিক সেই সময়ে মধ্য ভারতে ঘটে চলা একটি প্রতিবাদ আন্দোলন জলবায়ু পরিবর্তনের কেন্দ্রীয় চরিত্র রূপে নিয়ে এল আবার বৃক্ষ ও অরণ্যের কথা।

ভারতের অন্য অংশের মতই ছত্তিসগড়ের বড় একটা অংশই দাবাদহের শিকার হয়, তাপমাত্রা ছুঁয়ে ফেলে ৪৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। সেই গরমেও প্রতিধ্বনিত হয় আদিবাসী মহিলার কণ্ঠস্বর- "আমরা লড়াই ছাড়ব না!" তার কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায় জঙ্গলের অন্যদিকে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের গলাতেও-" আমরাই জিতব!" আদিবাসীরা এই প্রতিবাদ করছেন হাসদেও অরণ্যে নির্বিচার গাছ কাটার বিরুদ্ধে যা ছত্তিসগড়ের সরগুজা জেলায় তাদের গ্রাম সালহির কাছেই। স্লোগান তুলতে তুলতে তাঁরা জড়িয়ে ধরছেন গাছেদের।

গাছ বাঁচাতে তাকে জড়িয়েই চলছে বনবাসী মহিলাদের আন্দোলন

এপ্রিল মাসের ২৬ তারিখে গ্রামের লোকের ভোরের ঘুম ভেঙ্গে যায় বৈদ্যুতিক করাত আর গাছ পড়ার শব্দে। গাছ কাটার বড় বড় যন্ত্র আর জে সি বি মেশিন তখন অরণ্যে চলে এসেছে। যতক্ষণে মানুষজন এগিয়ে গেল, ততক্ষণে প্রায় ৩০০ গাছ কাটা সাঙ্গ। গাছ কাটার লোকেদের সঙ্গে পুলিশ ছিল।স্হানীয় মানুষজন গাছ কাটার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখতে চাইল ও এভাবে কাটাতে বাধা দিল। প্রশাসন অবশেষে কঠিন বাধার মুখে পড়ে স্হান ত্যাগ করে। তখন থেকেই হাসদেও অরণ্যে এই প্রতিবাদ চলছে। স্হানীয় মানুষজন দিনরাত পাহাড় দিচ্ছেন পালা করে অরণ্যকে।

স্হানীয় গ্রাম ফতেপুরের এক আদিবাসী যুবা মুনাওয়ার সিং পোর্তে জানান, " আমাদের বন আর গ্রাম বেআইনিভাবে বিভিন্ন কোম্পানি আর সরকার ধ্বংস করছে। দশ বছর ধরে আমরা এসবের বিরোধিতা করছি। কোনরকম শুনানিতে ডাকা হচ্ছে না আমাদের। এবারে আমরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধরনায় বসছি।"


একদশক ধরে হাসদেও অরণ্যকে বাঁচানোর এই প্রতিবাদ চলছে। যদিও ছত্তিসগড় সরকার গত বছরে কেন্দ্র সরকারের থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে পার্শা কয়লাখনি খননের অনুমতি দেয়। পার্শা কয়লাখনি সরগুজা ও সুরজপুর জেলার ১২৫২.৫ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এর আয়তন ৮৪১.৫ হেক্টর যার মধ্যে ৪১০.৯ হেক্টর বনভূমিতে পড়ছে। এই খনি রাজস্হান রাজ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন নিগমকে বরাদ্দ করা যা রাজস্হানের কংগ্রেস সরকার আদানি গোষ্ঠীকে MDO (Mine Developer-cum-Operator) চুক্তির ভিত্তিতে হস্তান্তর করে।

রাজস্হান রাজ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন নিগমকে এছাড়াও পার্শা পূর্ব কেটি বসন এলাকা বরাদ্দ করা হয়েছে খনির কাজের জন্য যা ২৭১১.০৩৪ হেক্টর জুড়ে বিস্তৃত। ১৭০০০০ হেক্টার জুড়ে বিস্তৃত হাসদেও অরণ্যের গভীর একটি অংশ হল এই খনি এলাকা।

হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে এই এলাকায় খনির বিরুদ্ধে হওয়া অনেকগুলি মামলা বকেয়া থাকলেও ছত্তিসগড় সরকার ২০২২ এর মার্চে এই পার্শা পূর্ব কেটি বসন এলাকায় খনির অনুমতি দিয়ে দেয়।

ছত্তিসগড় বাঁচাও আন্দোলনের একজন কর্মী অলোক শুক্লা, যিনি এইসব খনিসংক্রান্ত বিষয়ে যুক্ত তিনি জানালেন - " আমাদের মতে শুধু যে কয়েকশো মানুষ এই খনিগুলির জন্য উৎখাত হবেন তাই নয়, প্রায় সাড়ে ৪ লক্ষ গাছ কাটা হবে। এই ভয়াবহ পরিণতির বিরুদ্ধে আমরা মাটিতে এবং আদালতেও লড়ে যাচ্ছি"।

আশ্চর্যজনকভাবে, রাজস্হান ও ছত্তিসগড়ের কংগ্রেস সরকার যারা আগে আদানিদের বিরোধিতা করেছিল, তারাই এই খনিগুলো করতে অনুমতি দিল। আর বিরোধী বিজেপিও এ বিষয়ে চুপ কারণ তারা তো আগেই এ ব্যাপারে মত দিয়েছিল।

হাসদেও সংরক্ষিত অরণ্যে ১৮ট কয়লাখনি এলাকা চিহ্নিত। এই অরণ্যে কয়েকশো হাতি আর অন্যান্য জীবজন্তুর বাস। তাছাড়াও এই বন হাসদেও-বাঙ্গো বাঁধের অববাহিকা অঞ্চল, যে বাঁধের জল ৩ লক্ষ হেক্টর দ্বি-ফসলি জমি সেচের কাজে লাগে।

এর সজীব বাস্তুতন্ত্র ও ব্যাপক জীববৈচিত্রের জন্য এই অরণ্যকে বন ও পরিবেশমন্ত্রক ২০১০ সালে ‘No Go Area’ বলে ঘোষণা করে বিস্তৃত সমীক্ষার পর ও সবরকম খনন কার্য নিষিদ্ধ করে।

পরিহাসের বিষয়, এর এক বছরের মধ্যেই পাশা পূর্ব কেটি বসন এলাকার খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের অনুমোদন চলে আসে কম খরচে বেশি কয়লা উৎপাদনের নীতি নিয়ে। এটা অবশ্য প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, আর কোন খনির অনুমতি দেওয়া হবে না হাসদেও অরণ্যে। পরবর্তীতে বিষয়টি আদালতে গেলে, আদালত এই অনুমতি রদ করে দেয়।

তবে, সরকারের আবেদনে সাড়া দিয়ে আদালত খনির কাজ চালিয়ে যেতে বলে পরবর্তী নির্দেশ অবধি এবং হাসদেও অরণ্যের বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশের ওপর একটি বিস্তৃত সমীক্ষার নির্দেশ দেন কোন বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান যেমন Wildlife Institute of India বা the Indian Council of Forestry Research and Education, Dehradun থেকে। সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত রায় দেয়নি এবং তা আদালতের বিচারাধীন রয়েছে।

২০২১ সালে রাজস্হান সরকার ছত্তিসগড় সরকারকে চাপ দেওয়া শুরু করে পার্শা পূর্ব কেটি বসন ও পার্শা খনির অনুমতি দেওয়ার জন্য এবং একথা জানায় ২০২৮ অবধি তাদের বরাদ্দের সব কয়লা শেষ হয়ে গেছে।

এলাকার আদিবাসী মানুষজন এর বিরুদ্ধে ধর্নায় বসেন মাসের পর মাস। তারা বলেন পার্শা কয়লা খাদান আসলে পঞ্চম তফশিলের অন্তর্ভুক্ত এলাকায় যা আদিবাসী অধ্যুষিত। তাই খনি চালু করতে গ্রামসভার অনুমতি নিতে হবে আইন মোতাবেক। গ্রামবাসীদের অভিযোগ রাজস্হান সরকার নকল গ্রামসভার অনুমতিপত্র দাখিল করেছে অনুমতি পেতে। তাদের আরও অভিযোগ, Coal Bearing Act ব্যবহার করে জমি অধিগ্রহণ করা হয় যেখানে Land Acquisition Act কার্যকর করতে হত জমি নিতে।

স্হানীয় বাসিন্দাদের ধর্না প্রতিবাদ।

রাজস্হান সরকারের এই চাপ দেবার সময়ে, আদিবাসীরা দল বেঁধে মদনপুর থেকে রায়পুরে যান ৩০০ কিলোমিটার হেঁটে এবং মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালের সাথে দেখা করে এই জমি অধিগ্রহণ বন্ধ করতে আবেদন জানান। আদিবাসীদের একটি প্রতিনিধি দল কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর সাথে দেখা করে ও তাঁকে নির্বাচনের আগে হাসদেও অরণ্য নিয়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন আদিবাসীদের উচ্ছেদ যাতে না হতে হয় সেটা কংগ্রেস দেখবে। গান্ধী আরও বলেছিলেন, আদিবাসীদের অস্তিত্ব অরণ্যের উপর নির্ভরশীল এবং এমন কোন উন্নয়ন কাজের দরকার নেই যেখানে তাদের উচ্ছেদ করতে হয়।

২০১৮ এর ২রা জানুয়ারি Wildlife Institute of India এবং the Indian Council of Forestry Research and Education এর তৈরি করা একটি সমীক্ষা-পত্র সুপ্রিম কোর্টে জমা করা হয়।

এই সমীক্ষায় বলা হয়, যেখানে দেশের মাত্র এক শতাংশ হাতির উপস্থিতি রয়েছে ছত্তিসগড়ে, সেখানে দেশের ১৫ শতাংশ হাতি-মানুষে সংঘাতের ঘটনা এখানে ঘটছে। সমীক্ষায় পরিষ্কার বলা হয় এই সংঘাত ঠেকানো অসম্ভব হয়ে যাবে যদি এখানে খনির কাজ শুরু হয়। এই নথিতে এখানে উপস্থিত ৪০৬টি পাখির প্রজাতির মধ্যে বেশ কিছু সংকটাপন্ন ও অতি সংকটাপন্ন প্রজাতির উপস্থিতি উল্লেখ আছে। এখানে বাঘের উপস্থিতির কথাও উল্লেখ করা হয় ও বেশ কিছু বিরল জানোয়ারের উপস্থিতির কথা জানানো হয়। তাছাড়া এই বনের যোগাযোগ আছে ভোরামদেও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, কানহা টাইগার রিজার্ভ ও আচানাকমার টাইগার রিজার্ভের সাথে।

এইসব নথি জমা হবার পরে ও আন্দোলন চলা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক থেকে ২০২১ এর ২১শে অক্টোবর পার্শা এলাকার অরণ্য কাটার ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হয়। তারপরে ২০২২ এর এপ্রিল থেকে রাজ্য সরকার এই লক্ষ্যে কাজ শুরু করে।

একমাসের মধ্যেই আদানি গ্রুপ থেকে গাছ কাটা শুরু হয় বনদপ্তরের সহযোগিতায়। কিন্তু রুখে দাঁড়ান গ্রামবাসীরা। গাছেদের জড়িয়ে ধরে রুখে দেন কুঠারের আঘাত। মামলা করা হয় অনেকের বিরুদ্ধে তাঁদের। তবুও পুরুষ, মহিলা ও নাবালকেরাও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

এর মধ্যেই স্হানীয়রা আবার ছত্তিসগড় হাইকোর্টে যান গাছ কাটা বন্ধ ও খনির কাজ বন্ধের আবেদন নিয়ে। আদালত এইভাবে তাড়াতাড়িতে গাছ কাটার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং বলেন, জমি অধিগ্রহণের বিষয়টা যদি আর না এগোয়, কেটে ফেলা গাছগুলিকে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া যাবে? রাজ্য সরকারের কাছে উত্তর চাওয়া হয়।

অপরদিকে স্হানীয় মানুষজনের থেকে চিঠি পেয়ে National Tiger Conservation Authority তাদের কোন অনুমতি ছাড়াই ওই অরণ্যে যে গাছ কাটা হচ্ছে, খনির কাজ হচ্ছে সে ব্যাপারে রাজ্য সরকারকে ব্যবস্হা নিতে বলে। এই বিষয়ে তারা রাজ্য সরকারকে একটি রিপোর্ট পাঠাতে বলে।

নিজের দলের অবস্হানের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজ্যের একজন সাংসদ কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রী অশ্বিনী চৌবেকে পার্শা কয়লাখনির অনুমতি বাতিল করার দাবিতে চিঠি দেন। দেশের অনেক পরিবেশবিদই এই ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। রাজ্য সরকার আরও চাপে পড়ে যায় যখন কবীরপন্হী সম্প্রদায়ের প্রধান গুরু প্রকাশ মুনি নাম সাহেব এই কয়লাখনি ও গাছ কাটার বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সমর্থন জানান।ছত্তিসগড়ে কবীরপন্হীদের হাজার হাজার অনুগামী রয়েছেন। অনেক বিধায়ক, মন্ত্রী , এমনকি বিধানসভার অধ্যক্ষ অবধি এই গোষ্ঠীর। তাঁর একটি বার্তায় এই ধর্মগুরু জানান যে, "সমগ্র কবীরপন্হী সমাজের তরফে আমি হাসদেও অরণ্যের নিধনের বিরোধিতা করছি। আমি সমস্ত কবীরপন্হীদের অনুরোধ করছি এই অনৈতিক কাজের বিরোধিতা করার জন্য, কারণ অরণ্যের একটা গাছ কাটা মানে একশ জীবনের হত্যার সামিল।"

হরিহরপুর, ঘাটবারা, সালহির মত আদিবাসী গ্রাম যা পার্শা খনি এলাকায় পড়ছে, সেখানকার বাসিন্দারা জমি না দেওয়ার বিষয়ে একমত। দু'মাসের উপর ধর্নায় বসা সালহি গ্রামের এক মহিলা বলেন, " আমরা জঙ্গলের লোক। আমাদের গোটা জীবন এর উপরে নির্ভরশীল। যদি এই অরণ্য ধ্বংস হয়, তবে যে আদিবাসীরা এখানে কয়েকশ' বছর ধরে বাস করছে তারা উচ্ছেদ হয়ে যাবে। আমরা প্রাণ দেব, তবে এখানে কয়লাখনি হতে দেব না।"

হাসদেও অরণ্য বাঁচাও সমিতির আহ্বায়ক ও পাতুরিয়াদান্ড গ্রামের সরপঞ্চ উমেশ্বর সিং আমরো বলেন, " হাসদেও অরণ্য খুবই সমৃদ্ধ অরণ্য যেখানে বাঘ, চিতাবাঘ বা হরিণের মত জানোয়ার আছে অনেক। হাতিদের একটা বড় দল এখানেই পাকাপাকিভাবে থাকে। এই অরণ্য আমাদের দেবতার বাসস্হান। এই বন মধ্য ভারতের পরিবেশ রক্ষার সহায়ক। হাসদেও বাঁচলে , দেশ বাঁচবে এটা সবাইকে বুঝতে হবে।


ছবি: লেখক


মূল প্রবন্ধটি Mongabayপত্রিকায় প্রকাশিত। ইংলিশ প্রবন্ধটির অনুমতিক্রমে অনুবাদ করা হল বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য। মূল প্রবন্ধটির লিঙ্ক:

https://india.mongabay.com/2022/05/in-the-midst-of-coal-shortage-reports-a-coal-mine-extension-is-approved-in-pristine-hasdeo-forests/

Comentarios


Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page