top of page

বড়গল্প: দার্জিলিঙের কাছে (পর্ব ২)

..

শারদীয়া মানেই পুজোর গল্প-উপন্যাস বাংলা ভাষায়। বনেপাহাড়ের পাতায় প্রকাশ হচ্ছে ধারাবাহিক আকারে বড়গল্প। বন -জঙ্গল, পাহাড়ের পটভূমিতেই। অপূর্ব কুমার রায়ের কলমে। আগামী সংখ্যায় সমাপ্য।



সেদিন রাতে ম্যানেজার বাংলোয় দেবলীনার সম্মানে পার্টি, খাওয়া-দাওয়া। এসেছেন আরো দুই অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার মি: সিং আর মি:খান। কিন্তু রোহিত নেই! সে নাকি গেছে চা-বাগানের অন্যদিকে এক শ্রমিক-বসতিতে। সেখানে রাতে রোজ একটা চিতাবাঘের আনাগোনা হচ্ছে। ও তাই সেখানে ট্র্যাপ ক্যামেরা লাগাতে গেছে। রাতের বেলায় চিতাবাঘটা যখন আসবে তার ছবি , ভিডিও ধরে রাখতে হবে। চিনে রাখবে তাদের এস্টেটের এক না-মানুষ বাসিন্দাকে। খেতে বসে, সবার সাথে গল্প- আড্ডার মাঝেও দেবলীনার মন যেন পড়ে থাকল ওইদিকেই।





পরদিন কাজ একটু তাড়াতাড়ি শেষ হতে ড্রাইভারকে বলল রোহিতের বাংলোর দিকে নিয়ে যেতে। ড্রাইভার প্রবীন কি একটু বাঁকা হাসল ওর দিকে তাকিয়ে? নাকি এমন মনে হয়! রোগের সাইন সিম্পটমগুলো দেবলীনা একটু একটু বুঝতে পারছে ওর। ব্যাপারটা যে ওর খুব ভাল ঠেকছে তা নয়। কিন্তু রোগ কি কখনও মানুষের ইচ্ছা মেনে আসে! রোগীর শরীর, মন তো রোগের বশেই এসে যায়।

রোহিত তখনও ফেরেনি কাজ থেকে। চৌকিদার ওকে দরজা খুলে দিল। ওর চোখেও কি সন্দিগ্ধ দৃষ্টি? না দেবলীনাই আজ নিজের প্রতি নিজের সন্দেহ সবার প্রতি ছড়িয়ে যেতে দেখছে?

রোহিতের সেই ঘরটায় আজ পুরুষালি একটা গন্ধের সাথে একটা বনজ গন্ধ পেল ও। ঘাস, জঙ্গল, গাছপালা, পাথর, নদীর জল সবাই যেন মিলেমিশে আছে। একদিন যেমন ফর্মালিন, বিটাডিন, রিংগারের গন্ধে ওর পুরুষকে খুঁজে পেত দেবলীনা, তেমনটাই কি? ভাবতে ভাবতে রোহিতের বিছানাটায় এসে বসল ও। হাত দিয়ে খামচে ধরল চাদরটাকে। হাতটা ঘেমে আছে একটা উত্তেজনায়, শিহরনে। আবার উঠে পড়ে পায়চারি করতে লাগল।

বাইরে বাইকের আওয়াজ হল। রোহিতের গলার আওয়াজ। বারান্দায় এসে দাঁড়াল দেবলীনা। নীচে পথ দিয়ে আসতে আসতে ওকে উপরের বারান্দায় দেখে থমকে দাঁড়াল রোহিত। ওর মুখটাও কি একটু লাল হয়ে গেল? নাকি নিজের উত্তেজনাটাই ও দেখছে রোহিতের মধ্যে।

"হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইস!", সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল রোহিত।

"আপনার গুহায় আবার অভিযান চালালাম"।

"হা হা হা...বেড়ে বলেছেন। গুহাই বটে। beast এর গুহায় beauty"

রোহিতের মুখে beauty কথাটা শুনেই আবার একটু শিহরন খেলে গেল দেবলীনার শরীরে।

"অরণ্যদেবকে দেখতে এলাম। তা মশাই, কাল আপনার এমন নৈশ অভিযানের কথা জানতে পারলাম না যে!"

"কার থেকে শুনলেন? ও: স্যার বলেছেন নিশ্চই!"

" আসুন কালকের কিছু ভিডিও দেখাই আপনাকে । "

নিজের ঘরে গিয়ে ল্যাপটপ খুলে ট্র্যাপ ক্যামেরায় তোলা চিতাবাঘের ভিডিও খুলল। দেখাতে দেখাতে রোহিত যখন বর্ণনা দিচ্ছিল গত রাতের অভিজ্ঞতার, তখন চিতাবাঘ না ওর দিকেই তাকিয়ে গোগ্রাসে গিলছিল দেবলীনার চোখ দু'টো।

“ আপনার তো চা-বাগানের কাজ ছেড়ে বনবিভাগেই জয়েন করা উচিত।“

“তেমন কোন ব্যাপার না,” রোহিত বলল। “ সবাই তো বনবিভাগে কাজ করবে না। কিন্তু এই প্রকৃতি, অরণ্য, বনের পশু-পাখি এদের সবাইকে রক্ষা করা তো সবারই দায়িত্ব। আমি সেটুকুই করার চেষ্টা করছি।“

“প্রকৃতির সাথেই আপনার সব প্রেম দেখতে পাচ্ছি!”

“ তা বলতে পারেন। আমি প্রকৃতিকে ভালবাসি। সেও আমায় ফিরিয়ে দেয়। অনেক বেশি ফিরিয়ে দেয় তার ভালবাসা। আর কে এভাবে দেবে বলুন! কোন মানুষ কি পারবে?”

“আপনার সাথে আলাপ হল বলে জানতে পারলাম এখনও রোজকার কাজের মাঝেও প্রকৃতির সাথে কিভাবে জড়িয়ে থাকতে হয়। আপনাদের বাকি যে অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারের সাথে আলাপ হল, কথা বলে তো মনে হল না তারা কোন খোঁজ রাখেন তারা কোন প্রকৃতির জগতে থাকেন, কোন সম্পদ তাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। আর আমরা যারা শহরে থাকি তাদের কথা তো বাদই দিন।“

“শহরে থেকেও অনেক মানুষ কিন্তু প্রকৃতি নিয়ে বেঁচে থাকেন। ওই ধুলো, দূষণ, যন্ত্রণার মধ্যেও অনেকে অনেক কাজ করে যাচ্ছেন দেশের প্রকৃতি বাঁচাতে। তারা সেখানে বসে ওই কাজগুলো না করলে, আমাদের বনে-জঙ্গলে পাহাড়ে প্রকৃতি সবার অগোচরে কারা নষ্ট করে দেবে আপনারা জানতেও পারবেন না”, রোহিত বলল।

"আসুন আপনাকে আমাদের কারখানায় নিয়ে যাই। চা-বাগানে এসে একটু ভাল করে দেখে যান কেমন ভাবে চা-পাতা প্রসেস হয়ে পৌঁছায় দেশে-বিদেশে।"

রোহিতের বাইকে চেপে কারখানায় এসে পৌঁছাল ওরা। তখনও বিকেলের আলো চারপাশে। কারখানার ভিতর থেকে নানা রকম আওয়াজ আসছে। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল লম্বা একটা জাল জাল জায়গায় প্রচুর পাতা রাখা।

“দেখুন এখানে গরম হাওয়া আসছে জালের নীচ থেকে। চা পাতার যে আর্দ্রতা আছে, তা শুষে নেওয়া হচ্ছে,” রোহিত দেখাল।

“ আমার তো গন্ধটাই বেশ লাগছে। আপনাদের কারখানায় ঢুকে চায়ের গন্ধেই বেশ নেশা-নেশা লাগছে,” আধো-অন্ধকার ঘরে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বলল দেবলীনা।

পুরানো ব্রিটিশ যুগের কারখানা। অনেক জায়গা আজও অপরবর্তিত। কাঠের সিঁড়ি, পুরানো লোহার সব মেশিন। চা পাতা শুকিয়ে, রোল পাকিয়ে, সম্পূর্ণ তৈরি হতে কোন কোন পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয় ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিল রোহিত। নানা রকম চা-পাতা দেবলীনার হাতে ঢেলে প্রকারভেদ বোঝাচ্ছিল।

“ এত কিছু বুঝতে পারছি না মশাই। ওই যে ফার্স্ট ফ্লাশ, সেকেন্ড ফ্লাশ বলে সেসব কী জিনিস? সেগুলো এখানে হয়?”, দেবলীনা জানতে চাইল।

“ সে তো হবেই। সব বাগানেই হয়। ওগুলো চা পাতা কোন সময়ে তৈরি হচ্ছে তার উপরে বলা হয়। যেমন মরশুমের শুরুতে বসন্তের সময়ে আমরা প্রথম যে পাতা তুলি তার থেকে ফার্স্ট ফ্লাশ টী আসে। এটা সবথেকে ভাল চা। বলতে পারেন দার্জিলিঙের ফার্স্ট ফ্লাশের প্রায় পুরোটাই বিদেশে চলে যায়। একেবারে ধনকুবেরদের ঘরে। তারপরে গ্রীষ্মকালে আসে সেকেন্ড ফ্লাশ। এটাও খুব ভাল। আর এখন এই বর্ষায় অল্প অল্প রেনি ফ্লাশ ওঠে। অক্টোবার আসছে। তখন অটাম ফ্লাশ উঠবে।“

“বাপরে, এত রকমের ভাগাভাগি সময়ের উপর”, মন দিয়ে শুনতে শুনতে বলল দেবলীনা।

“ এবার টেস্টিং রুমে আসুন,” দেবলীনাকে পাশের একটা ঘরে ডাকল রোহিত।

ঘরটায় নানা রকম পেটিতে চা-পাতা সাজানো রয়েছে।রয়েছে দুটো হিটার আর বাসনপত্র। দুটোতেই জল চাপিয়ে তাতে দুটো দু’রকম পেটি থেকে অল্প অল্প চা-পাতা নিয়ে মিশিয়ে দিল রোহিত।

“এবার ম্যাজিক দেখুন”, দুটো বানানো চা দু’টো কাপে ঢেলে রোহিত বলল-“দেখুন রং দেখে কোনটা কোন ফ্লাশ বলুন”।

“এ তো জানিনা। তবে এই হলুদ রং এর চা টি কী? গ্রীণ টি’র মত লাগছে!”

“ওটাই ফার্স্ট ফ্লাশ। প্রকৃতির প্রথম স্পর্শের মতই হালকা। যেমন রঙে, তেমন স্বাদে। তাই তো এর এত কদর। আর দ্বিতীয়টা যেটি গাঢ় রং এর-সেটি সেকেন্ড ফ্লাশ।….নিন দুটোই চেখে দেখুন। আপনার জন্য বানালাম”।

“আপনি তো টী-টেস্টার বানিয়ে দিলেন দেখছি”।

“পড়েছেন মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে তার হাতে”, হাসতে হাসতে রোহিত বলল।

রোহিতের বাইকে চেপে ম্যানেজার বাংলোয় ফিরে যেতে যেতে মাথার ওপর সবুজ পাতার ছাতার মত রাস্তাকে ঘিরে রাখা, তার উপরে নীল আকাশ, বাতাসে ভেসে আসা গাছপালার সুগন্ধ, ঝিঝি পোকার তীব্র ডাক- এমন এক অদ্ভুত ভাললাগায় আচ্ছন্ন বিকেল খুঁজে পেল দেবলীনা। এত ভাললাগার আবেশ ওর মনে , মাথায় বহুদিন পরে এল যেন কতযুগের ওপার থেকে। সত্যিই কি প্রকৃতিই শুধু এমন ভাললাগায় আচ্ছন্ন করতে পারে? না তেমন কোন মানুষের সঙ্গই সবকিছুকে ভরিয়ে দেয় এমন ভাবে! পুজো আসছে। সময়টাই এমন ভাললাগার হয়ত। ভালবাসা খুঁজে পাবার।

“আপনাদের এখানে পুজো হয়?”, দেবলীনা জানতে চাইল।

“বা:! তা হবে না? পুজো কি শুধু বাঙালীরাই করে? আমাদের চা-বাগানেও পুজোর ক’টা দিন খুব হুল্লোড়!”

“ আপনি এখানেই থাকেন পুজোয়?”

“সপ্তমী অবধি। তারপরে বাড়ি ফিরি। পুজোরর ক’টা দিন মা’র কাছে যেতে কার না মন চায়!”

হঠাৎ বাইক থামিয়ে দিল রোহিত। নীচের চা-বাগানের দিকে ও তাকিয়ে। কিছু লোক সেখানে ঘোরাফেরা করছে।

“হতচ্ছাড়ারা আবার এসছে উপদ্রব করতে!”

“কী ব্যাপার হচ্ছে ওখানে?”

“শখের ফটোগ্রাফারের দল। বলা ভাল ফটো-ডাকাতের দল। এদের ফটোগ্রাফার বললে ফটোগ্রাফির মত অত সুন্দর জিনিসটার অপমান হয়! এইখানে কিছু পাখি বাসা বেঁধেছে। কলারড ফ্যালকনেট। খুব সুন্দর দেখতে দেখতে ছোট ছোট শিকারি পাখি। আমাদের বাগানে অন্তত আগে দেখিনি। গত এক-দুই মাসে এসেছে হয়ত। ঠিক এদের কাছে খবর চলে গেছে। তা যাক! কিন্তু এই দলটাকে আমি চিনি। শিলিগুড়ির কিছু বড়লোক বাবার ধরাকে সরা জ্ঞান করা ছেলেপুলে। পাখির ছবি তোলার নাম করে যাচ্ছে তাই অত্যাচার করে। এর আগে একাধিকবার পাখির বাসার কাছে গিয়ে ছবি তুলতে তুলতে পাখির বাসা ভেঙ্গে দিয়েছে। ওদের আগেও আমি সতর্ক করেছিলাম……”।

“আপনি একটু অপেক্ষা করুন তো। ওদের না আটকালে যেটা করবে আমি মেনে নিতে পারব না!”

রোহিত বাইক থেকে নেমে চা-গাছের মধ্যের সরু পথ ধরে নামতে লাগল ওদের দিকে।

দেবলীনা দেখতে পেল নামতে নামতেই ছেলেগুলোর সাথে একটু উত্তেজিত বাক্যালাপ শুরু হয়ে গেল রোহিতের। ওর কী করা উচিৎ ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু ওর মনে হল ওর রোহিতের পিছনে গিয়ে দাঁড়ানো উচিত। আস্তে আস্তে ও নামতে লাগল চা-বাগানের পথ দিয়ে।

“…. তোমাদের কতবার বলেছি যে পাখির ছবি তুলতে হলে দূর থেকে তোলো। এভাবে পাখির বাসার কাছে যাবে না। বিরক্ত করবে না।“

“আর আপনি কি হিমালয়ের পাখিদের ঠেকা নিয়ে রেখেছেন নাকি রোহিতবাবু? কোথায় কি করব আপনি শেখাবেন? আপনার এক্তিয়ার কি এখানে কথা বলার”, ওদের মধ্যে মাতব্বর গোছের একজনের চিৎকার।

“হ্যাঁ নিয়ে রেখেছি। তোমাদের মত দুদিনের শখের ফটোগ্রাফারের থেকে সেটা শিখতে হবে না কোনটা আমার এক্তিয়ার! আর এই চা-বাগানে তো নয়ই। যদি সম্ভব হয় হিমালয়ের অন্য জায়গাতেও তোমাদের পিছনে তাড়া করব!”

“ আরে পাগলে গেছ নাকি ম্যানেজার,,,,ছবি তুলতে গিয়ে যদি পাখির কিছু হয় তো তোমার কি? তুমি কি ফরেস্টের লোক এলে নাকি?”

“How shameless you people are!! যাদের ছবি নিয়ে এখানে ওখানে দেখিয়ে নাম ফাটাবে, তাদের প্রতি কোন দায় নেই তোমাদের! সেটা আমি জানি আগেই। তাই তোমাদের এসব করতে বারন করেছি। নাউ গেট লস্ট ফ্রম হিয়ার!”

“আবে চুপ বে…!" পিছন থেকে একটা মোটা করে ছেলে, হাতে বিশাল বড় এক লেনস্-ক্যামেরা- বলে উঠল। তারপর এগিয়ে এসে রোহিতকে এক ধাক্কা। ছিটকে গিয়ে পাহাড়ের ঢালের উপর রোহিত পড়ল, মাথাটা লাগল একটা পাথরে। বিশ্রী একটা আওয়াজ হল। তখন দেবলীনা প্রায় ওখানে এসে গেছে।

“হোয়াট ইজ্ দিজ! স্টপ ইট…স্টপ ইট!”, চিৎকার করে উঠল ও।

রোহিতের মাথা থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে তখন। রক্ত দেখে একটু বোধহয় ভয় পেয়ে গেল ছেলেগুলো। তার উপর দেবলীনাকে দেখে ওরা আরো হকচকিয়ে গেল। পিছিয়ে গেল এক পা-দু’পা করে।

দেবলীনা কী করবে বুঝতে পারছিল না! পকেট থেকে রুমাল বার করে চেপে ধরল রোহিতের ক্ষতস্থানে। ছেলেগুলো তখন উপরের পথ ধরে দৌড়।

“শালা বড়লোকের ছেলেপুলে….আর চাপ নিতে পারল না”, হেসে উঠল রোহিত।

“ আপনি হাসছেন…এখন তো হসপিটালে যেতে হবে। আপনার ড্রেসিং দরকার! কেন করতে গেলেন এমন…যাক সে নিয়ে পরে কথা বলব। এখন ফিরবেন কিভাবে এই অবস্থায়”!

"দাঁড়ান, দাঁড়ান। মাথা ঠান্ডা করুন।"

পকেট থেকে মোবাইল বার করে ও ফোন করল ড্রাইভার প্রবীণকে। গাড়ি নিয়ে এই জায়গায় আসতে বলে দিল তক্ষুনি।

“ আমার মাথা ফেটেছে সেটা বড় কথা নয় বুঝলেন ডক্টর। পাখিগুলোকে আপাতত উপদ্রবের থেকে, মানুষের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে পারলাম। এগুলো তো করে যেতেই হবে। ক’টা লোক আর ওদের নিয়ে ভাবে বলুন। আমরা যারা আছি ওদের দলে গুটিকয়েক লোক, তারাও যদি রুখে না দাঁড়াই….তবে ওদের আমি ছাড়ব না। এর জন্য যা করার এরপর আমি করব”, রোহিতের জেদ চেপে যাওয়া রক্তাক্ত মুখে তখন সন্ধের অন্ধকারেও হাজার ওয়াটের আলো।

হসপিটালে ম্যানেজার বিশ্বাস চলে এসেছিলেন। ড্রেসিং , ইঞ্জেকশান সব কিছুর পর ওরা সবাই মিলে রোহিতকে ওর কোয়ার্টারে পৌঁছে দিতে গেল।

“ এমন বাউন্ডুলেপনা আর কতদিন চলবে রোহিত! এবার তোমার মা-বাবা’কে চিঠি লিখে তোমার বিয়ের একটা ব্যবস্থা করতে হবে দেখছি”, বিশ্বাসবাবুর খেদোক্তি।

“হাসাবেন না স্যার। হাসলে ব্যথা লাগছে কপালে টান পড়ে…..বিয়ে করলেই কোন সমাধান হবে আপনার সমস্যার? ঢেকি কি স্বর্গে গিয়ে ধান ভানবে না?”

“তুমি এখন বিশ্রাম নাও ক’টা দিন। এই ক’দিন তোমার সেকশানের কাজ আমি আর সিং মিলে দেখে নেব”।

“বিশ্রাম তো হবে না স্যার। কালই একবার লোকাল থানায় যেতে হবে। আর ফরেস্টের অফিসেও। এরপর তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না…”।

“সেসব আমি দেখব ক্ষণ। দরকারে থানা থেকে পুলিশ আসবে তোমার বয়ান নিতে। “

“আপনি এখন একটু ঘুমান। যে ধকল গেল, এখন পুরো রেস্ট দরকার আপনার”, দেবলীনা বলল পাশ থেকে। পুরোটা চিকিৎসার সময়ে দেবলীনা ছিল ডা: চ্যাটার্জীর সাথে । একটা উদ্বেগে, মনকষ্টে ওর ভিতরটা তোলপাড় হচ্ছিল।

“ আমরা এখন আসি। কোন অসুবিধায় ফোন করবেন”, দেবলীনা উঠে এল রোহিতের পাশ থেকে। বড় অনিচ্ছায়। এই অবস্থায় রোহিতকে ছেড়ে যেতে মন দিচ্ছিল না ওর। অন্তত আজকের দিনটা। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় ও জানে।

আঙ্গুলে মৃদু একটা ছোঁয়া পেয়ে দেখল রোহিত আলতো করে ওর হাতটা ধরেছে। ওর সদা বোহেমিয়ান চোখে যেন তখন ঘন ছায়া। ও কি কিছু খুঁজছে? কাউকে খুঁজছে?


আজ দেবলীনার শেষদিন এখানে। কাজকর্ম মোটামুটি বোঝানোর পালা শেষ। আজ থেকে রুগীদের পরিষেবা দেওয়া শুরু নতুন যন্ত্রপাতিতে। থেকে থেকেই রোহিতের কথা মনে পড়ছে। আজ আবার কেমন মেঘ করে এসেছে। বেশ ঠান্ডা চারিদিকে। কাল রাতে দেবলীনার বারবার রোহিতের চোখদুটো মনে আসছিল। সেগুলো ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমের মধ্যে রোহিত, রক্ত, পাখি, একদল ডাকাত- এসব স্বপ্নে এসেছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মনে পড়ছে ওর। কাজের মাঝে একবার ফোন করল রোহিতকে। রিং হয়ে গেল। আবার একটু পরে করল। আবার রিং বেজে গেল। উদ্বিগ্ন দেবলীনা ফোন করল ম্যানেজার বিশ্বাসকে।

“রোহিত তোমাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দিয়েছে বুঝতে পারছি ক’দিনে। ভেবোনা ও ঠিক আছে। ঘুমাচ্ছে বোধহয়। সকালবেলা আমি গিয়ে খবর নিয়ে এসেছি”, বিশ্বাসবাবু জানালেন।

দেবলীনার মনকেমনের কথা বোধহয় ম্যানেজার বাবু, মায় গোটা বাগানের লোক হয়ত জেনে গেছে। এনটাই যেন মনে হচ্ছে ওর। কিন্তু তা হোক। এমন একজন মানুষের জন্য মনকেমন করাই যায়। একজন ভাল মানুষ, সাচ্চা মানুষ। আর অন্য কিছু আকর্ষণ যদি নাও থেকে থাকে রোহিতের জন্য। কে কী ভাবল তা নিয়ে সংকোচ করাটা আর এই বয়সে এসে, নিজের জায়গায় পৌঁছে দেবলীনাকে মানায় না বলেই ওর মনে হল।

কাজ শেষ হবার আগে দুপুরের পরেই দেবলীনার ফোন বেজে উঠল। রোহিত।

“ এক্সট্রিমলি সরি ডক্টর, আপনার ফোন এসেছিল। আমি আসলে ঘুমিয়ে ছিলাম। কাল রাতে আসলে ভাল করে ঘুম হয়নি। তাই সকালে খুব ঘুমিয়ে পড়েছিলাম…”

“ খুব ভাল কথা। সেটাই তো দরকার ছিল। আপনি এখন কেমন ফিল করছেন?”

“দিব্যি ভাল আছি। এই তো লাঞ্চ করে উঠে বারান্দায় বসে দিব্যি কফিতে চুমুক দিচ্ছি। পাখিদের গান শুনছি”, রোহিত বলল। “ আপনাকে আমি ফোন করতাম। কাল তো আপনি চলে যাবেন। বলেছিলাম এখানে একদিন বার বি কিউ করে আপনাকে ডাকব। আজ আমার কুক রাজনকে চিকেন মেরিনেট করতে বললাম। আপনি আজ চলে আসুন কাজের পর। “

“সেকি! এসব কি করছেন। আপনি এখন ক’দিন রেস্ট নিন। সেরে উঠতে হবে তো তাড়াতাড়ি।“

“রেস্ট আর কোথায়! এই তো থানা থেকে এক্ষুনি একজন কনস্টেবল এসেছিলেন। সব অভিযোগ রেকর্ড করে নিয়ে গেলেন। বকবক করে গেলাম বসে বসে। আপনি এলে বরং রেস্টও হবে, আর আপনাকে ফেয়ার ওয়েল না দিতে পারার আক্ষেপও থাকবে না। কি বিপদেই কাল ফেলেছিলাম আপনাকে! যতবার ভাবছি ততবার খারাপ লাগছে!”

“ সেকি! খারাপ তো আমার লাগার কথা। আমি ওখানে থেকেও আপনার এমন বিপদ হয়ে গেল, কিছু সাহায্য করতে পারিনি।“

“ আপনি ছিলেন বলেই বিপদ আর বাড়ে নি। নাহলে হয় ওদের, নয় আমার কাল কারুর একটা বড় বিপদ তো হতই। আমি তো ওই অবস্থায় ছেড়ে দেওয়ার বান্দা নই….”।

“থাক হয়েছে। আপনি এখন শান্ত হন। আমি যাব আপনার কাছে। তারপরে বার বি কিউ হবে না কি হবে সে দেখা যাবে…”।

কাজের শেষবেলা হসপিটালের স্টাফরা, কিছু শ্রমিক, রুগী এরাও সবাই ভিড় করে এসেছিল। বড় আন্তরিক এখানকার মানুষ। শহরের ব্যস্ত হসপিটালে থেকে মানুষের সাথে সেই যোগাযোগের সুযোগ কোথায়, বিশেষত দেবলীনার কাজ ল্যাবরেটরিতে। আর মানুষও সেখানে আলাদা। হয়ত এমন জায়গায় থালে মানুষের মন সত্যিই এখানকার প্রকৃতির মতই খোলামেলা হয়ে যায়। কেউ কেউ তো বলেই ফেলল, দিদি আপনি এখানে থেকে যান। ডা: চ্যাটার্জীর তো অনেক বয়স হল। আর আগের মত সবদিক সামলাতে পারেন না। কম বয়েসী কেউ এলে হসপিটালটা প্রাণ ফিরে পায়। দেবলীনা কিছু বলতে পারল না। মনের মধ্যে ভিড় করে আসা অনেক উদ্বেগ, সংশয় আর আবেগ ঠোঁটের কোণে একটা হাসিতে ধরে রেখেই বিদায় নিল ও।

প্রবীণকে রাতে ওকে নিতে আসার কথা বলে দেবলীনা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল রোহিতের বাংলোর দিকে। ক’পা এগোতেই বাংলোর বাগানের একদিকে রোহিতকে দেখতে পেল ও।

“ একি! কী করছেন আপনি? বিশ্রামে নেই কেন?”, দেবলীনার গলায় উদ্বেগ।

“বিশ্রামেই তো আছি ম্যাডাম”, একগাল হাসি রোহিতের মুখে। “নাহলে রোহিত বোস কি আর ঘরে বসে থাকার বান্দা!”

“দেখুন এখানেই আমার ওপেন এয়ার বার বি কিউয়ের ব্যবস্থা। বিকেল তো হয়ে গেছে। চলুন একটু নদীর ধারে বসা যাক। ফ্লাস্কে গরম গরম ফার্স্ট ফ্লাশ বানানো আছে। তারপরে ফিরে এসে বার বি কিউ।“

“পাগল আছেন আপনি, বদ্ধ উন্মাদ”, দেবলীনা বলল হাসতে হাসতে।

“পাগল বলতে পারেন, পথভোলা পথিক বলতে পারেন…যা খুশি। আমার প্রিয় গানের লাইনই তো- আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি!” দেবলীনার পাশে পাশে নদীর দিকে নামতে নামতে বলল রোহিত।

“ভাল হত যদি আপনার স্রোতে ভেসে যেতে পারতাম“।

“পারাটা যে খুব সহজ তা বলব না, কিন্তু কঠিনও কিছু না। আমি যেভাবে দেখি জীবনটা সেভাবে দেখলে হয়ত আপনারাও পারবেন”।

নদীর ধারে তখন একদল বক উড়ছে। খাবারের খোঁজে।

“মাথার উপরে দেখুন”, রোহিতের গলায় উত্তেজনা। একদল বড় বড় কি যেন পাখি উড়ে যাচ্ছে দল বেঁধে একটার পর একটা।

“ কী পাখি ওরা?”, দেবলীনার গলায় বিস্ময়।

“হর্নবিল। গ্রেট হর্নবিল। আমাদের এদিকে আছে এরা ঝাঁকে ঝাঁকে। এখানে এসে এদের না দেখলে আপনার বড় একটা মিস হয়ে যেত। যাক। কাল আপনি চলে যাবেন। তার আগে ওরা দেখা দিয়ে গেল।"

রোহিত নদীর ধারের একটা পাথরে বসে ওদের উড়ে যাবার পথের দিকে চেয়েছিল। দেবলীনার দেখে মনে হল এই নদী, পাহাড়, বন, চা-বাগান- এদের মালিক যেই হোক না কেন। যেন এখানকার রাজা রোহিতই। ওই তো বসে আছে ওর পাথরের সিংহাসনে। আর এই পাখি, গাছপালা, জন্তুদের নিয়েই ওর রাজত্ব।


সন্ধ্যার অন্ধকারে বাতাসটা বার বি কিউয়ের পোড়া গন্ধে ম-ম করছিল। রাজেনের মেরিনেট করে দেওয়া চিকেনের পিসগুলো বড় যত্নে পুড়িয়ে পুড়িয়ে তুলে রাখছে রোহিত।

“ আপনার কি চলে? ড্রিঙ্কস্?”, দেবলীনার দিকে জানতে চাইল ও।

“সে তো চলে কখনও কখনও।ভদকা আর বিয়রই বেশি”।

“ এই সন্ধ্যায় আর ভদকা নেবেন কি! আর আমি দেবই বা কোত্থেকে। তবে আমার কাছে একটা জ্যাক ডেনিয়েলের বোতল রয়েছে। এক দাদা গিফ্ট করেছিল। আপনার সম্মানে নাহয় আজ সেটার উদ্বোধন হোক”।

ঘরের ভিতর থেকে হুইস্কির বোতল নিয়ে বেরিয়ে এসে রোহিত বলল, "বার বি কিউয়ের সাথে জ্যাক ডেনিয়েল। এর চেয়ে বেশি ভাল করে আর আপনাকে আমি এই জঙলী বাসায় আপ্যায়ন করতে পারতাম না।"


(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

Comments


474525369_1074216644505260_833710345513391369_n.jpg
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
Co-editor: Dr. Oishimaya Sen Nag

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page