বাংলার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জগতে একটি বিশিষ্ট নাম অবসরপ্রাপ্ত লেফট্যানেন্ট কর্নেল শক্তিরঞ্জন ব্যানার্জী। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে দীর্ঘ কর্মজীবনে যেমন তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর তরফে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, তেমনই World wide fund for Nature (WWF) এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতিও ছিলেন। তার সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের Wildlife Advisory Board এর সদস্য এবং কলকাতা আর দার্জিলিঙের Honorary wildlife warden ছিলেন দীর্ঘ ১৫ বছর।
অভিজ্ঞতার ঝুলি তাঁর বিরাট। তাঁর সাথে এইসব নিয়ে আলাপ করতে একদিন সন্ধ্যায় বনেপাহাড়ে পত্রিকার তরফে তাঁর কলকাতার বাড়িতে পৌঁছে গেছিলাম আমরা দুই সম্পাদক- সুমন্ত ভট্টাচার্য্য ও ঐশিমায়া সেন নাগ। বৈঠকি আড্ডায় যেসব গল্প উঠে এল সেইদিন তা ভাগ করে নিলাম বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য।
বনেপাহাড়ে: সেনার জীবন ও বন্যপ্রাণ নিয়ে কাজ । দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। দুটোর মেলবন্ধন ঘটল কিভাবে?
লে:ক: ব্যানার্জী: দুটোর মেলবন্ধন ঘটেছে , কারণ বরাবরই এই বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল। এই যে বাড়িতে আমি বড় হয়েছি এখানে বরাবরই বিভিন্ন জন্তু জানোয়ার ছিল। খরগোশ, হাঁস, পায়রা এসব পালন হত। সেই থেকেই আগ্রহটা আমার আসে। আর সেনাবাহিনীতে তো পরে গেছি। আগে দেরাদুনের রাষ্ট্রীয় ইন্ডিয়ন মিলিটারি কলেজে পড়েছি। সেটা ছিল পুরো জঙ্গলে ঘেরা জায়গা। আর দেরাদুনে তো জানেনই পাহাড়, জঙ্গল সবকিছু আছে। সেখানে থাকাকালীন তখনও যেহেতু ১৯৭২ এর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন আসেনি, আমাদের জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হত শিকারের জন্য। শিকার হয়ত করিনি, কিন্তু এইসব নিয়ে একটা ধারনা হয়েছে। আর মনে হযেছে যে, জন্তুজানোয়ার মারব না। বরং দেখতে হবে এটাকে কী করে রক্ষা করা যায়। সেখানে নানারকম ম্যাগাজিন পড়ে দেখতাম। “এনিমেল” নামে একটা পত্রিকা আসত, ইউ কে তে প্রকাশ হত। সেটা পড়তাম। সেখানে লেখা থাকত কিভাবে জীবজন্তুর ফটোগ্রাফি হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে আগ্রহটা বাড়ে। এরপর বিভিন্ন স্থানে যেমন নাগাল্যান্ডে বা বিষ্ণোইদের গ্রামে কর্মসূত্রে থাকার সময়ে সেখানে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।
আর্মিতে অনেকেই আছেন বা ছিলেন যারা ওয়াইল্ডলাইফ নিয়ে অনেক করেছেন। জিম করবেট নিজেই একজন আর্মির লোক ছিলেন। Jerdon’s courser- যে পাখিটা আর পাওয়া যাচ্ছে না তার নাম যার নামে সেই Jerdon নিজে আর্মির লোক ছিলেন। সালিম আলি বলেছিলেন জেনারেল সুন্দরজিকে যে, তোমরা যদি দেশের সুরক্ষায় থাকতে পারো তবে পরিবেশের সুরক্ষায় কেন নয়। জেনারেল সুন্দরজি তখন শুরু করলেন ইকোলজি সেল। আমি সৌভাগ্যবশত: প্রথম থেকেই সেই ইকোলজি সেলের অংশ ছিলাম। ১৯৮৬ সালে দিল্লীতে যখন ছিলাম আর্মি সদর দপ্তরে তখন আমায় এই দায়িত্ব দেওয়া শয়। আমি আর্মির নেওয়া বিভিন্ন এই সংক্রান্ত কার্যক্রমের দায়িত্বে ছিলাম। আর্মির কাছে আমি কৃতজ্ঞ আমায় এই সুযোগগুলি দেবার জন্য।
আমাদের যে অস্ত্রাগার বা আ্যামিউনেশান ডিপোগুলো ছিল সেগুলো তো লোকচক্ষুর আড়ালে তাকত। যে কেউ যেতে পারত না সুরক্ষার কারণেই। তাই সেগুলো এমনিই সুরক্ষা পেত। সেখানে অনেক জল রাখা থাকত আগুনের থেকে বাঁচার জন্য। সেগুলো পাখিদের কাজে লাগত। ড: সালিম আলি বলেছিলেন দেখে যে, এ তো দারুণ ব্যবস্থা।
বনেপাহাড়ে: সেনাবাহিনীর কাজের ডিউটির সময় ও এইসব কাজের মধ্যে কোন অসুবিধা ঘটত না?
লে:ক: ব্যানার্জী: সেটা হয়নি …এই যেমন ধরো আমি নাগাল্যান্ডে পিকেটে ছিলাম। পিকেটে থাকলে যেটা শয় জন্তু জানোয়ারগুলো ওখান দিয়ে চলাফেরা করে। আমি তাদের ওপর সার্ভে করছি। আমি নিজে স্বাধীন যেহেতু পিকেটের কমান্ডার। আশেপাশে জঙ্গল। স্থানীয় মানুষেরা প্রচুর শিকার করে। ওদের আমি বলতাম যে, এভাবে শিকার কর কেন এত! সচেতনতা প্রচারটা অনেক করেছি। স্থানীয় স্কুলের শিক্ষকদের বলতাম যে তোমরা কেন এত কথায় কথায় মারো। এভাবেই করতাম। তাতে তো কোন সমস্যা হয়নি। আর পরে যখন ইকো-সেলটা তৈরি হল, যার বিভিন্ন কার্যক্রম নেওয়া হল-তখন তো কোন সমস্যাই ছিল না।
বনেপাহাড়ে: স্যার, এতদিনের এইসব কাজকর্মে অনেক অভিজ্ঞতা তো আপনার হয়েছে। কিন্তু সবথেকে ‘থ্রিলিং’ অভিজ্ঞতা কী মনে হয়েছে?
লে:ক: ব্যানার্জী: সেটা আলাদা করে বলা মুশকিল। এমন অনেক অভিজ্ঞতাই হয়েছে। হাতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এমন অনেক আভিজ্ঞতা হয়েছে। অনেক সময় পালাতে হয়েছে। একটা অভিজ্ঞতার কথা বলব। সুকনায় যেখানে ছিলাম সেটা তো মহানন্দা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি এলাকা। সেখানে লেপার্ড আসে। হাতি তো আসেই। এখন WWF এর species programme এর যিনি প্রধান সেই দীপঙ্কর ঘোষ তখন ওখানে দার্জিলিং গভর্মেন্ট কলেজে এম এস সি পড়ছিল। ও প্রকৃতি সংসদেও ছিল। ও আসত দার্জিলিং থেকে ছুটি পেলে। ওর সাথে আমরা বেড়াতে যেতাম। একদিন হয়েছে কি, আমার সঙ্গে থাকা ভুটিয়া কুকুরটাকে নিয়ে রাত্তির বেলা হাঁটতে বেড়িয়েছিলাম। আমি হাতে বড় সার্চলাইট নিয়ে একদিকে দেখছি, দীপঙ্কর একদিকে দেখছে। হাতির জন্য। আমাদের অন্য কোন চিন্তা ছিল না। হাতে লাঠি থাকত হঠাৎ করে লেপার্ড এসে গেলে তাড়াতে। আমাদের জন্য ভয় না, কুকুরটার জন্য। বাঁদিকে ফরেস্ট রেঞ্জটা ছিল। রাস্তাটা গিয়ে ওখানে একটি গভীর নদী ক্রস করে বামনপোখরি রেঞ্জের লামাগোম্ফা বিটের জঙ্গল। নদীর দিকে যখন এগিয়ে গেছি, দেখি দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে কী যেন মনোযোগ দিয়ে দেখছে। আমাকে ডাকল আসার জন্য। আমি জিজ্ঞাসা করতে ও বলল- লেপার্ড! আমার চিন্তা ছিল কুকুরটাকে নিয়ে। আমি ওকে বললাম যে তুই টর্চটা ফোকাস করে রাখ। আমি কুকুরটা নিয়ে আস্তে আস্তে ফিরছি। আর কুকুর কি হয় দেখেছি, আমারটাকেও দেখেছি- হাতি দেখলেই ঘাউ ঘাউ ঘাউ করে খুব চিৎকার করে। কিন্তু লেপার্ড দেখে একেবারে চুপ। ভয়ে আছে। আমি যেই একটু এগিযেছি দেখি দীপঙ্কর দৌড়ে আসছে। ও বলল- আমি যেই টর্চটা সরিয়েছি তখন লেপার্ডটা এমন করল যেন আমার উপর ঝাঁপাবে। আমি বললাম- চল চল তাড়াতাড়ি চল। একটা মাঠ ছিল আর সেখানে একটা বাড়ি ছিল। তার পাশের একটা গলি দিয়ে আমাদের ঘরে ফিরে গেলাম। কুকুরটাকে রেখে আমরা আবার লেপার্ড দেখতে গেলাম। ফিরে গিয়ে দেখলাম যেখানে বসেছিল, সেখানে পায়ের ছাপ আছে। কিন্তু ওটাকে পেলাম না। তারপরে সেই মাঠের পাশে বাড়িতে যারা থাকত তারা আমায় ফোন করল। বলল- জানেন কর্নেল ব্যনার্জী একটা চিতাবাঘ আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল !
অর্থাৎ চিতাবাঘটা আমাদের অনুসরণ করেছে। আমরা তো পিছনে দেখিনি। আমরা গলিতে ঢুকে যেতে ও দাঁড়িয়ে গেছে বাড়ির সামনের ছোট মাঠটায়। সেখানে কাকে একটা দেখে –ঘাঁ করে আওয়াজ করে চলে গেছে। এমন সব অভিজ্ঞতা আছে নানা।
একবার যেমন সুন্দরবনে গোসাবার অধীনে বালি নামে একটা গ্রাম আছে। সেখানে গ্রামের শিক্ষা প্রসারের কাজে ছিলাম। WWF থেকে এসেছিল গোটা টীম সেইসব নিয়ে একটি ফিল্ম বানাতে। বিখ্যাত ওয়াল্ডলাইফ ফিল্ম পরিচালক মাইক পান্ডের সহকারী এসেছেন। তা আমি একদিন নদীর পাশে বসে ছিলাম। ওপারে জঙ্গল। গ্রামের ছেলেরা বলল, স্যার এখানে বাঘ আসে। বসবেন না!
আমি বললাম, আমার অত ভয়-টয় নেই।
ওরা শুনবে না। পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সব।
পরেরদিন সকালে শুনি বাঘ এসেছে। আমি যেখানে বসেছিলাম সেখান দিয়েই। তা বাঘটা আনারস ক্ষেতে লুকিয়ে আছে খবর পাওয়া গেল। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা সব চেষ্টা করছে (যাদের মধ্যে এখন বিখ্যাত গাইড, এককালের চোরাশিকারী অনিল মিস্ত্রীও ছিল) লোকজনকে সরাতে।
কেউ একটা ঢিল মেরে দিয়েছে। বাঘটা বেড়িয়ে এসে এক মহিলাকে আর একটি বাচ্চা ছেলেকে আক্রমণ করে আহত করে দিয়েছে। আসলে সামনে পড়ে গেছিল বাঘের। তারা গেছে অজ্ঞান হয়ে।
আমার ভয় হচ্ছে, গ্রামের লোক মেরে না দেয় বাঘটাকে। WWF ডাইরেক্টারের সামনে মারলে তার থেকে আর লজ্জার কিছু হত না। তবে গোসাবা থানার পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছিল। জায়গাটা ঘিরে দেওয়া হয়। বাঘটা একটা ঘরে আটকে ছিল। তাকে ঘুমপাড়ানি গুলিতে কাবু করে পরে জঙ্গরে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই যে গ্রামে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করা হচ্ছিল, তার মধ্যেই বাস্তব একটা সচেতনতামূলক কাজ হয়ে গেল।
বনেপাহাড়ে: স্যারের সাথে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের অনেক দিনের সম্পর্ক। তারা বন্যপ্রাণ নিয়ে অনেক কাজ করে। এই নিয়ে স্যারের অভিজ্ঞতা যদি কিছু বলেন। তাদের সাথে কেমন ভাবে সম্পর্ক হয়?
লে:ক: ব্যানার্জী: আমি রাজস্থানে শ্রীগঙ্গানগর জেলায় লালগড় জটান বলে একটা জায়গায় কর্মসূত্রে ছিলাম। আমার বস খুব ভাল লোক ছিলেন। উনি খুব পরিবেশ সচেতন মানুষ। উনি আমাকে বললেন বিষ্ণোইদের কাছে যেতে। দুলপুরা বলে একটা গ্রাম আছে। সেখানে গেলাম বিষ্ণোইদের সাথে কথা বলতে। কিন্তু ওরা কথা বলতে চায় না। ফৌজি দেখেছে আসলে। বলছে ফৌজিরা এসে মেরে দেবে। আসলে একটা ভয় কাজ করছিল ওদের মধ্যে আমাদের দেখে।
তাহলে কি করা যায়? আমরা তখন আমাদের পরিবারের মহিলাদের নিয়ে গেলাম। তখন ওরা রাজি হল। কথাবার্তা হল।
তখন শঙ্করলাল বিষ্ণোই বলে একজন ছিল, সে বলল তোমরা শিকার তো করবে না? আমরা বললাম- না। সেইজন্য আমরা আসিনি? তোমরা কিভাবে কাজ করতে চাও বরং বলো। তারা জানাল- সেখানে নায়েক বলে একটা সম্প্রদায় আছে, শিখরা আছে। তারা প্রাণীহত্যা করে। সেটা আমরা যাতে আটকাই সেই অনুরোধ ওরা রাখল। তখন সেখানে কিছু সেনাবাহিনীর গাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। তারা পাহারা দিতে থাকল। ওরা তখন আস্তে আস্তে বুঝল যে, আর্মির লোক এসে কৃষ্ণসার বা চিংকারা মারবে না। এভাবে ওরা বিশ্বাস ও ভরসা পেল।
আমরা সেখানে মাটি কেটে সেখানে জলের ট্যাংক এনে জল ভরলাম। কৃষ্ণসার হরিণদের কাজে লাগল তা। কুলগাছের পাতা কেটে এনে সেখানে দিলাম হরিণদের জন্য। এটা বিষ্ণোইদের খুব ভাল লাগল। শ্রীগঙ্গানগরে কর্নেল চিমা ছিলেন। তিনি তিনবার মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছিলেন। তিনি ওখানে মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব করেছিলেন। সেখানে একবার এডমন্ড হিলারিকে তিনি নিয়ে আসেন। সেখানে হিলারিকে রাখার তেমন জায়গা ছিল না। তাই সেনাবাহিনীর এখানেই ছিলেন। তাকে নিয়ে আমরাও নানা অনুষ্ঠান করি।
আমি একদিন হিলারি সাহেবকে বললাম যে, আপনি তো পাহাড়ের মানুষ। এবার আপনাকে আমি মরুভূমি দেখাব। তখন ওনাকে আমার জিপেই নিজে ড্রাইভ করে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরালাম, কৃষ্ণসার হরিণ দেখালাম। তারপরে বিষ্ণোইদের গ্রামে নিয়ে গেলাম। বললাম ওরা কিভাবে রক্ষা করে কৃষ্ণসার হরিণদের। বিষ্ণোইরা তাঁকে দেখে বলছে যাকে নিয়ে আমরা ইতিহাসে পড়েছি, তিনিই সামনে দাঁড়িয়ে! কেউ কেউ তো বিশ্বাসই করতে পারল না যে সত্যিই তিনি এডমন্ড হিলারি। তবে ওখানকার ‘রাজস্থান’ বলে একটি পত্রিকায় হিলারির সাক্ষাৎকার প্রকাশের পরে ওরা সত্যিই বোঝে যে ইনি হিলারিই ছিলেন।
এরপরে ওরা আমাকে নিয়ে যায় সন্ত কুমার বিষ্ণোইয়ের কাছে। উনি অল ইন্ডিয়া জিভ-রক্সা বিষ্ণোই সভার সভাপতি ছিলেন। তিনি পাঞ্জাবের দোতরোয়ালি গ্রামে থাকতেন। পাঞ্জাবে ১৩টি গ্রামকে অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছিল। সেখানে কৃষ্ণসার হরিণদের রক্ষা করত বিষ্ণোইরাই, বনবিভাগ নয়। ভাতিন্দা জেলায়। সেখানে সন্ত কুমার বিষ্ণোইয়ের সাথে ওরা আমার আলাপ করান। তখন থেকেই ওদের সাথে খুব হৃদ্যতা আমার। এরপর যখন আমি দিল্লীতে ছিলাম, তখন সেখানে বিষ্ণোই সমাজের অনেক রকম অনুষ্ঠান হয়। সেখানে আমি নিয়মিত যেতাম।
মোকাম বলে একটা জায়গায় ওরা বড় করে শিবরাত্রি করে। তখন ওরা জীবরক্ষায় যারা জড়িত, তাদের পুরস্কার দেয়। সন্তকুমারজী আমায় জানালেন একটি পুরস্কার দেবার কথা। সিলভার মেডেল সহ। বিখ্যাত বন্যপ্রাণী ফিল্ম পরিচালক মাইক পান্ডে লোক পাঠালেন অনুষ্ঠানটির চিত্রগ্রহণের জন্য।
ওদের গুরু জাম্বেশ্বরজি পিপাসার বলে যোধপুরের কাছের একটা গ্রামে জন্মেছিলেন। উনি যখন এই সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করেন , তখন ২৯টি নীতি-আদর্শ স্থাপনা করেন। এর মধ্যে জন্তু জানোয়ার না মারা, গাছ না কাটা এসব তো ছিলই। এছাড়া মেয়েদের জন্যও অনেক যুগোপযোগী নীতি এতে ছিল। এই বিশ আর নয় থেকেই বিষ্ণোই শব্দটি এসেছিল। ওরা পুরো নিরামিষাশী। দেখেছি যে ওদের সংস্কৃতির পুরোটার মধ্যেই বন্যপ্রাণী আছে। বন্যপ্রাণী আর গাছ। আর খেজরি গাছটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। খেজরি গাছ থেকেই খেজরালি গ্রামের নাম। সেখানে ১৭৩০ সারে গাছ বাঁচানোর জন্য কয়েকশ মানুষ প্রাণ দেন। যখন যোধপুরের মহারাজ দুর্গ বানাতে কাঠ কাটতে লোক পাঠান। তখন অমৃতা দেবী এগিয়ে আসেন। রাজার সেনারা তাদের মেরে দেয়। তারপরে আরও মানুষ এগিয়ে আসে। ৩৬৩ জন মানুষ এভাবে প্রাণ দেয়। এই হল চিপকো আন্দোলনের শুরু। এর মধ্যে ৬৯ জন হলেন মহিলা।
তখন মহারাজা এসে ক্ষমা চান। বলেন যে আর বিষ্ণোই এলাকায় গাছ কাটা হবে না। এমনও দেখেছি যে কোন হরিণের বাচ্চার মা যদি কোন কারণে মারা যায়, এরা নিয়ে এসে উদ্ধার করে। কোন মা হয়ত তার বাচ্চার সাথেই হরিণ শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছে। এমনটা তো দেখা যায় না ওদের মত। খুবই আলাদা।
বনেপাহাড়ে: স্যার আপনার এতদিনের অভিজ্ঞতা বন্যপ্রাণী নিয়ে, এত রকম কাজ করেছেন। তা আপনার তরুণ প্রজন্মের জন্য কী পরামর্শ?
লে:ক: ব্যানার্জী: তরুণ প্রজন্মকে নিজেই এগিয়ে আসতে হবে। তারাই বাঁচাতে পারবে। অনেকেই এগিয়ে আসছি। কিন্তু অল্প দেখেই অনেক কিছু জেনে গেছি এমনটা অনেকে ভাবছে তারা। এটা আমি দেখেছি। এটা হওয়া উচিৎ নয়। অভিজ্ঞতা বলে তো একটা ব্যাপার আছে। অনেকেই আজকাল সাপ উদ্ধার করছে, ধরছে। এইসব তো দীপক মিত্র, হুইটেকাররা একসময় শিখিয়েছেন। অনেকেই করছেন এখন। কিন্তু অনেকেই ওস্তাদি দেখাতে যাচ্ছে। সাপ ধরতে জানি, সাপ নিয়ে খেলা করি তাই- এমনটা হওয়া উচিৎ নয়। এটাকে বন্যপ্রাণী হিসাবে দেখো। এগুলো একসময় আমি করেছি। এখন তো বয়স হয়ে গেছে। আর সাহস করি না, রিফ্লেক্স চলে গেছে।
আর গঠনমূলক কাজ করতে হবে। শুধু বক্তৃতা দিলাম, ফেসবুকে ছবি দিয়ে দিলাম- এভাবে হবে না। প্রাণীদের কিভাবে বাঁচাব, পরিবেশে রাখতে পারব- এগুলো ভাবতে হবে।
বনেপাহাড়ে: আপনার যে বইটি প্রকাশিত হয়েছে সেইটি সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন।
লে:ক: ব্যানার্জী: আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে এইসব কাজে তা নিয়েই সাধারণ ভাবে লিখেছি। যাতে লোকে সহজ ভাষায় পড়ে, বোঝে। বিরাট বড় করতে চাইনি। আজকাল তো কেউ বই পড়তেও চায় না। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো লিখেছি। বিশিষ্ট বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ আনোয়ারুদ্দিন চৌধুরী এর ভূমিকাটা লিখেছেন।
শ্রী ব্যানার্জীর সাথে এরপরেও আমাদের গল্পগুজব চলে বেশ কিছুক্ষণ। অরণ্যপ্রেমীদের মনের মানুষ লেখক বুদ্ধদেব গুহর সাথে তার উত্তরবঙ্গে হঠাৎ হয়ে যাওয়া আলাপের কথাও উঠে আসে। মহানন্দা অভয়ারণ্যের কাছে লেখকের গাড়ির সাতে আর্মির গাড়ির সংঘর্ষে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। তখন তাঁকে আর্মির ক্যাম্পে নিয়ে এসে প্রাথমিক চিকিৎসা করা হয়। আর একদিন বুদ্ধদেব গুহর সাথে লেফট্যানেন্ট কর্নেলের আলাপের বিস্তারিত গল্প হবে বলে তিনি আমাদের বললেন।
লেফট্যানেন্ট কর্নেল ব্যানার্জী আমাদের তাঁর লেখা বইটিও দেন উপহারস্বরূপ।
Comments