নেপালের অন্যতম প্রখ্যাত ও সৌন্দর্যে ভরপুর ট্রেকিং পথ অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের ট্রেক। সেই পথে দল বেঁধে যাবার আনন্দই আলাদা। সেই বর্ণনা উঠে এল সুমন গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে।
"কি রে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পে যাবি?"- এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে খাওয়া-দাওয়া শেষে আড্ডা মারার সময় হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল আমারই মেডিকেল কলেজের সহপাঠী ঘনিষ্ঠ বন্ধু উপল। ধুকপুক করে উঠলো বুকটা।
-"40 এর মধ্য গগনে ক্রমবর্ধমান মধ্যপ্রদেশ নিয়ে-ট্রেকিং তাও কিনা অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প! "
-"ট্রেকিং করতে লাগে কিছুটা ফিটনেস ,পাহাড়কে অসম্ভব ভালোবাসা আর এনডিওরেন্স । আমার বিশ্বাস তুই পারবি ।"
উপল এর মধ্যেই গোটা ছয় ট্রেকিং করে , নিজের উৎসাহী ঘনিষ্ঠদের একত্রিত করে "Ardent Trekkers" নামে একটা দল তৈরি করেছে। তাই তার আশ্বাস বাণী শুনে মনের দ্বিধাদ্বন্দ্বকে দূরে সরিয়ে রাজি হয়ে গেলাম। তারপর জিনিসপত্র কেনাকাটার তোড়জোড় আর স্বপ্ন দেখা- ধবল শুভ্র শৃঙ্গরাজি, সাদা মেঘ খেলে বেড়ানো নীল আকাশ, অ্যালপাইন তৃণভূমি ,জঙ্গলে পাখির কুজন ,ঝর্ণার আওয়াজ,বিশালাকায় হ্যাঙ্গিং ব্রিজ।
৭ ই নভেম্বর ২০২৪। আরো দশ জন ভবঘুরে সাথীর সাথে নিজেকে নতুন করে জানতে বেরিয়ে পড়লাম হাওড়া স্টেশন থেকে। সঙ্গে উপল,অনির্বাণ ,সৌমিত্র, দেবজ্যোতি, জয়ব্রত ,হিমাদ্রি, রাতুল, সৌরভ ,অভি এবং বুদ্ধ। এদের মধ্যে আমার সাথে প্রথম চারজনই মেডিকেল কলেজের প্রাক্তনী। আমি ,অনির্বাণ ,জয়ব্রত ও দেবজ্যোতি প্রথমবার এই দলে ঢুকলাম। সঙ্গে দেশীয় গাইড প্রদীপ। মাউন্টেনিয়ারিং এর এডভান্সড কোর্স করা ৩৪ বছরের প্রাণোচ্ছল একটি ছেলে। পরের দিন সকালে রক্সউল স্টেশনে পৌঁছে সেখান থেকে একটা টেম্পো ট্রাভেলর করে রওনা দিলাম পোখরার উদ্দেশ্যে। সব রকমের পারমিট নিয়ে,সিম ও কারেন্সি চেঞ্জ করে ক্ষতবিক্ষত রাস্তা পার করে রাত নটার সময় পোখরা পৌঁছলাম।
প্রথম দিন।
পোখরা তে সকালে তৈরি হয়ে বেরোতেই দেখি আমাদের গাড়ি উপস্থিত। সঙ্গে নেপালি গাইড অঙ্কিত। যাত্রা শুরু আর পথের সঙ্গী মাঝেমধ্যে উচ্ছল পাহাড়ি নদী মোদি খোলা। এবড়োখেবড়ো ভাঙ্গা, না থাকার মত রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে তিন ঘন্টা পর পৌঁছলাম সোমরং। এখান থেকেই আমাদের ট্রেকিং শুরু। মিনিট পাঁচেক নামার পর নদী থেকে ১৪০মিটার উচ্চতায় ২৮৭ মিটার লম্বা সোমরং খোলা ব্রিজ।
এর সামনে দাঁড়িয়ে প্রদীপ আমাদের যাত্রাপথ সম্পর্কে ছোট্ট করে বিবরণ দিল। তার দিয়ে তৈরি করা ব্রিজের উপর দিয়ে যেতে যেতে নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরতে থাকে। হাওয়ায় ক্রমাগত দুলতে থাকা ব্রিজের উপর দিয়ে পার হতে হতে বুক শুকিয়ে যায়। ব্রিজের পরেই ঝিনু ডান্ডা। ১৭৮০ মিটার উঁচু ঝিনু ডাণ্ডা থেকেই শুরু হয় চড়াই। এখান থেকেই অসংখ্য সিঁড়ি বেয়ে খাড়াই উপরে উঠে চলা। মাঝেমধ্যে দু একটা দোকান আর ক্রম অপসৃয়মান ফেলে আসা সোমরং খোলা ব্রিজ ।এই প্রাণান্তকর চড়াইয়ের মাঝে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া। চারপাশে সবুজের সমাহার আর উঁচু পাহাড়ের হাতছানি। পাকদণ্ডি বেরোতেই হঠান করে দৃশ্যমান অন্নপূর্ণা সাউথ। শ্বেত শুভ্র অন্নপূর্ণার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে ক্লান্তি ভুলে আবার সিঁড়ি চড়া। পাহাড়ের হঠাৎ একটা বাঁকে চেরি ব্লসমের মত একটি গাছে ফুলের শোভা দেখে থমকে দাঁড়ালাম। ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল একটা Grosbeak পাখি । শরীরের পরিশ্রমে আর ক্যামেরা বার করার অবকাশ পেলাম না।। এইভাবে হাজার হাজার সিঁড়ি অতিক্রম করে প্রায় ন হাজার পদক্ষেপ পার করে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে ক্লান্ত দেহে পৌঁছলাম চোমরং।একটা Blue Whistling Thrush আওয়াজ করতে করতে আমাদের অভিবাদন জানিয়ে গেল । ২২১০ মিটার উঁচুতে চোমরং Annapurna Conservation Area র আগে শেষ গ্রাম। পৌঁছে ভাত দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন এর সাথে সাথেই বেশ ঠান্ডা লাগতে আরম্ভ করল। কয়েকটা বাড়ি নিয়ে সাজানো গোছানো সুন্দর গ্রাম এই চোমরং। চারিপাশে চেরি ব্লসমের মত অজানা ফুলের বাহার। আর বামদিকে অন্নপূর্ণা সাউথ আর ডানদিকে মাছুপুছরে । ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো পাহাড়ি গ্রামে। আদিগন্ত অন্ধকারের মাঝেও তুষার শুভ্র শৃঙ্গরাজির মায়াময় উপস্থিতি ভুলিয়ে দিল দিনের সমস্ত ক্লান্তিকে।
দ্বিতীয় দিন।
আজ অনেকটা পথ হাঁটতে হবে ।প্রাতরাশ সেরে সোওয়া ৭ টার মধ্যে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম। গ্রামের বাইরেই চেকপোস্টে পারমিট দেখিয়ে Annapurna Conservation Area তে ঢুকে পড়লাম। এবার জনপদের মধ্যে দিয়ে দু হাজারেরও বেশি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে পৌঁছে গেলাম আরেকটা তারের হ্যাঙ্গিং ব্রিজের কাছে। সেটা পার করে সিঁড়িপথে টানা চড়াই। রাস্তায় হঠাৎ দেখি শত শত Rose ringed parakeet র আওয়াজ এ জায়গাটা মুখরিত হয়ে আছে ।কখনো ওক, পাইন,জুনিপার ও গুড়াসের জঙ্গল, কখনো দু-একটা বাড়ি ,এভাবে চলতে চলতে বেশ কিছুক্ষণ পর পৌঁছে গেলাম লোয়ার সিনুয়া। ফুল দিয়ে সুসজ্জিত বেশ কিছু টি হাউস নিয়ে গড়ে উঠেছে এই জনপদ। এরপর আবার কিছুটা চড়াই, কিছুটা সিঁড়িপথ পেরিয়ে চলে এলো সিনুয়া। এরপর আবার সিঁড়ি। যেন স্বর্গের সিঁড়িপথ । হঠাৎ দেখলাম ঊর্ধ্বমুখী সিঁড়ি যেখানে বাঁক নিয়ে পাহাড়ের অন্যদিকে চলে গেছে সেখানে অন্নপূর্ণা সাউথ ভাস্বর হয়ে আছে। বিস্মিত বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকলাম সেই দিকে। এইভাবে আরো কিছুক্ষণ চলার পর পৌঁছে গেলাম আপার সিনুয়া। ২৩৪০ মিটার উঁচু এই জায়গায় হলো আমাদের কফি বিরতি। কফির সাথে সাথে সঙ্গী সাথীদের কিছু আড্ডা, কিছু হাসিঠাট্টা করে শক্তি সঞ্চয় করে আবার যাত্রা শুরু। ধীরে ধীরে চারপাশটার বেশ পরিবর্তন দেখা যেতে লাগল। জঙ্গল আরো ঘন হলো। গাছের চাদর পথকে এমন ভাবে ঢেকে দিল যাতে সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারছে না।
তারপর আবার বোল্ডারে ভরা নদী পথ। কখনো কাঠের পাটাতনের ব্রিজ, কখনো গাছের গুঁড়ি ফেলা অশক্ত ব্রিজের উপর সাবধানে হেঁটে নদী পার হওয়া। কখনো পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণা আমাদের যাত্রাপথকে ভিজিয়ে দিয়ে নিচে নেমে গেছে। গাছের মধ্যে বাঁশ গাছের আধিক্য এখন লক্ষ্নীয়। বুঝলাম বাম্বু অর্থাৎ আমাদের পরবর্তী গন্তব্য আসছে। এইভাবে চড়াই উতরাই পথে চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম ২৩১০ মিটার উঁচু বাম্বু গ্রামে। এখানেই মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি। নভেম্বরের পড়ন্ত বেলায় খাবার খেয়ে আবার চলতে লাগলাম। এই পথ প্রধানত জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে উপরে উঠে গেছে। পড়ন্ত বিকেলের মেঘ হঠাৎ করে এসে ছুঁয়ে গেল। ভালোলাগার এক অপার অনুভূতি নিয়ে চলতে লাগলাম পথ। সন্ধ্যা নামার আগেই পৌঁছে গেলাম আমাদের আজকের শেষ গন্তব্য আড়াই হাজার মিটার উঁচুতে দোভান।দুই পারে সবুজে মোড়া ঝর্ণার আওয়াজে মুখরিত সুউচ্চ পাহাড়ের কোলে দোভান আজ আমাদের রাত্রের আবাসস্থল। ওয়াইফাই কানেক্ট করে বাড়ির সাথে কথা বলে শুরু হলো আড্ডা। সন্ধ্যায় আমি উপল আর অনির্বাণ এই তিন বন্ধু একটা কফি শপ দেখে ঢুকে পড়লাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আড়াই হাজার মিটার ওপরে বসে ক্যাপুচিনো কফিতে চুমুক দিয়ে আড্ডা মারার যে কি অনুভূতি তা বলে বোঝানো যাবে না।
তৃতীয় দিন।
আজকের গন্তব্য মাছুপুছরে বেস ক্যাম্প। নতুন দিনে নতুন উদ্যমে শ্যামলিমা আর ঝরনার আওয়াজ কে সঙ্গী করে শুরু হলো পথ চলা। একটা Common Redstart দেখা দিয়েই জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। পাখিদের কুজন আর আমাদের লাঠির ঠক ঠকানি সঙ্গে জলস্রোতের শব্দ,সব মিলিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। পারস্পরিক ইয়ার্কি ঠাট্টা,প্রদীপের অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার গল্প,অন্যান্যদের আগের ট্রেকিং গুলোর অভিজ্ঞতার কথা,মাঝেমধ্যেই নিজেদের ছবি তোলা সব নিয়ে চলল তৃতীয় দিনের যাত্রা। এই সাহচর্যই যাদের মনে আশঙ্কা ছিল এই সফর সম্পূর্ণ করতে পারবে কিনা,তাদের আত্মপ্রত্যয় বাড়াতে থাকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা মিলল বিখ্যাত ১০৮ জলপ্রপাতের ভিউ পয়েন্ট। এই স্থানে পাহাড়ের গা বেয়ে অসংখ্য জল ধারা পাহাড়ের উপর থেকে নিচে নেমে আসছে। ওখানে রয়েছে বরাহ মন্দির। এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। এর একটু উপরেই রয়েছে পুরাতন মন্দিরটি। মন্দিরের ঘন্টার ধ্বনি ,শতজলধারার গুরু গম্ভীর আস্ফালন জায়গাটিকে সত্যি অনবদ্য করে তুলেছে। ছবি তোলার পর্ব চলতে চলতে বেশ কিছুটা সময় কেটে যায়। আবার চলতে হবে।
শ্যাওলা মাখা বোল্ডারের সিঁড়ি পার হয়ে আমরা উপরে উঠতে লাগলাম। যত উপরে উঠছি গাছপালাগুলো কেমন যেন ছোট হয়ে আসতে লাগলো। প্রকৃতির শ্যামল রূপ ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে ধূসরতায় পর্যবসিত হতে লাগলো। নিজের হৃৎস্পন্দন এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নিজের কানেই বাজতে লাগলো। এসে পৌঁছলাম ২৯০০ মিটার উচ্চতায় হিমালয় নামের একটি বিশ্রাম স্থলে। সাময়িক চা ও কফির বিরতির পর আবার পথ চলা শুরু। রাস্তা আরো চড়াই হচ্ছে। ডানদিকে চোখের সামনে ধরা দিল মাছুপুছরে। মাছের লেজের মত শ্বেত শুভ্র এই শৃঙ্গের আকর্ষণটাই আলাদা। এক রহস্যময় অধরা মাধুরী এক বিস্ময়কর রূপ নিয়ে সদর্পে দাঁড়িয়ে । এরপর পেরতে থাকলাম আরো অসংখ্য নাম না জানা ঝর্ণা,গর্জনমুখর পার্বত্য স্রোতস্বিনী। কখনো বন্ধুরা হাত ধরাধরি করে বোল্ডারে পা দিয়ে, কখনো অবহেলায় বসানো কাঠের পাটাতনের ওপরে পা দিয়ে পেরতে লাগলাম সেই সব নদী। অবশেষে পাহাড়ের এক বাঁকে এক গুহার মতো চাতাল এসে পড়ল। কয়েকটা ধাপের উপর এক বুদ্ধ মূর্তি, ডান হাত তুলে তিনি যেন সবাইকে অভয় দিচ্ছেন। ওই দূরে দেখা যায় দেওরালি। আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজনস্থান। ৩১৭০ মিটার উঁচু এই স্থান প্রাকৃতিক শোভায় ভরপুর। ঘন কুয়াশা নির্জনতা এই জায়গাটির আলাদা মাহাত্ম এনে দিয়েছে। আজকের শেষ গন্তব্য ৩৭০০ মিটার উচ্চতায় মাছুপুছরে বেস ক্যাম্প। ওখানেই আজকে রাত্তিরের আমাদের আবাসস্থল। আগামী পর্যায়ে আজ ৫০০ মিটারেরও বেশি উচ্চতা প্রাপ্তি হবে ।সুতরাং এই পথ যে কেমন হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। হাঁটা শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌঁছলাম নদীর সামনে। বড় বড় পাথরের উপর দিয়ে উচ্ছল বেগে বয়ে চলেছে মোদিখোলা। নদীর পাশে ধূসর তৃণভূমি।নদীর ধারে ছোট ছোট চ্যাপ্টা পাথর খন্ডের উপর পাথর চাপিয়ে অনেকেই মনস্কামনা পূরণের প্রার্থনা জানিয়ে গেছে।
সামনে ছোট্ট একটা শিব মন্দির। চারপাশে নাতি উচ্চ পাতা ঝরা গাছের সমাহার। এক অদ্ভুত মোহময় পরিবেশ। থামলে চলবে না । হেঁটে যেতে হবে। সামনে প্রাণান্তকর চড়াই আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। হৃদযন্ত্রে মাঝেমধ্যে প্রবল ধাক্কা এবং নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে শুনতে এগোতে লাগলাম। ৮ থেকে ১০ পা হাঁটতে হাঁটতেই একটু বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। এদিকে পাহাড়ের বুকে ধীরে ধীরে নেমে আসছে অন্ধকার। সঙ্গী সাথীরা কেউবা এগিয়ে কেউ বা পিছিয়ে আছে এলোমেলো ভাবে। একজন বলল আর পারছিনা, ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু থামাতো যাবে না এগিয়ে তো যেতেই হবে। একে অপরকে আশ্বাস দিতে দিতে নিজেকে আশ্বস্ত করে চড়াই ভাঙা চলতে থাকল। হঠাৎ পাহাড়ের এক কোণে উঁকি দিল দিনান্তের সূর্যের শেষ রশ্মির রক্তিম আভা গায়ে মেখে মাছুপুছরে।তার মাথায় একাদশীর বাঁকা চাঁদ। এ যেন চন্দ্রমৌলি মহাদেব আপন রূপে কিছু মুহূর্তের জন্য ভাস্বর হয়ে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন। পথের ক্লান্তি উধাও। আবার নতুন উদ্যমে অন্ধকারে ঢাকা পাহাড়ি পথে হাঁটা শুরু।ভরসা মাথার হেড ল্যাম্প ।সামনেই স্রোতস্বিনীর শব্দ কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। টর্চ এর আলো ফেলে উপল একটা ব্রিজের দিকে নির্দেশ করল। অন্ধকারে লোহার রডের ব্রিজ পেরিয়ে চড়াই হেঁটে পৌঁছলাম আমাদের আজকের গন্তব্য। আমাদের দলে শেষ সঙ্গী সাথীরা এসে যখন পৌঁছল তখন ঘড়িতে প্রায় সাতটা ।পথের ক্লান্তি তার সাথে প্রায় শূন্য ডিগ্রীর কাছাকাছি উষ্ণতা। কারো বা মাথা ধরেছে কারো বা বমি বমি ভাব। Acute Mountain Sickness।রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে গিয়েও শুধু এক আচ্ছন্নতা। সারারাত একটা অদ্ভুত অস্বস্তি। কম্পমান বুকে ট্রেকিং এর চূড়ান্ত পর্যায়ে আগামীকাল পৌঁছানোর শঙ্কা মিশ্রিত অপেক্ষা ।
চতুর্থ দিন।
১২ ই নভেম্বর ২০২৪ । আজ আমাদের অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পে পৌঁছানোর দিন। সকালে সূর্যোদয়ের আগেই সকলে পাহাড়ের উপর সূর্যোদয় রূপ ক্যামেরা বন্দী করার জন্য প্রস্তুত। বারান্দায় ও টেবিলে পড়ে থাকার শিশির বিন্দু জমাট বাঁধা বরফ হয়ে গেছে। তারপরে মাছুপুছরে শৃঙ্গের উপর সূর্যের প্রথম আলো পড়ার মহেন্দ্রক্ষন। ক্যামেরার শাটারের শব্দে ভরে গেল বেস ক্যাম্প। সকাল ন'টা নাগাদ আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে যাত্রা শুরু। ধূসর অ্যালপাইন তৃণভূমির মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ উঠে গেছে। কখনো সূর্যের তাপে ঘেমে উঠছি ,কখনো মেঘ এসে গিয়ে কনকনে ঠাণ্ডা। জ্যাকেট খোলা পরার সঙ্গে চলছে ঠাণ্ডা হওয়ার দাপট। দূরে ঝর্নার আওয়াজ। কোন কোন নদীর স্রোত বরফে জমে আছে।
সঙ্গী সাথীদের কেউ বমি করার চেষ্টা করে চলেছে অথচ হচ্ছে না। সবারই অল্পবিস্তার মাথা টিপটিপ করছে। শুকনো ফল, লজেন্স মুখে দিয়ে বারবার জল খেয়ে ধীর পদক্ষেপে হেঁটে উচ্চতাজনিত অসুস্থতা প্রতিহত করার দুর্বার চেষ্টার করে চললাম। ঘন্টা তিনেক হাঁটার পর দেখতে পেলাম "নমস্তে -অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ABC 4130 metres" লেখা বোর্ডটা। চোখ থেকে নামলো জলের ধারা। একে অপরকে জড়িয়ে ধরা, আমাদের ট্রেকের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা উপলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন - এক আবেগ বিহ্বল মুহূর্ত। বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে সবাই একসাথে,আলাদা করে ছবি তোলা । গাওয়া হলো ভারতের জাতীয় সংগীত।
এবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে চললাম আমাদের আজকের বাসস্থান টি হাউজের উদ্দেশ্যে ।ওয়াইফাই এর কানেকশন পেয়ে পরিবার-পরিজনকে জানানো এবং খুশিতে উচ্ছ্বসিত হওয়ার মুহূর্ত। মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে সামনেই একটা ভিউ পয়েন্টে গেলাম। যেন আমরা পৃথিবীর এক শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি। নিচে খাড়াই গহবর আর তারপরেই উঠেছে অন্নপূর্ণা সাউথ। মেঘ বরফ আর কুয়াশায় ঢাকা এক অধরা মাধুরী। অন্নপূর্ণা পর্বতারোহণে মৃত্যুর হার খুব বেশি। ভিউ পয়েন্টে অসংখ্য প্রার্থনা পতাকা দিয়ে ঘেরা বেশ কিছু মৃত পর্বতারোহীর ফলক। ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল মনটা। একটা ফলকে চোখে পড়ল- "Alex MacIntyre 1954-1982: Better to live one day as a tiger than to live thousand years as a sheep"
টি হাউসে ফিরে আসতেই পেলাম oven baked fresh pizza with Yak cheese। সত্যিই ভাবা যায় না। এবার সূর্য ডোবার পালা। পাহাড় সূর্যের আলো আর মেঘের খেলা এবং তার সাথে শাটারের শব্দ। রাত আটটার মধ্যে খেয়ে দেয়ে লেপের তলায় নিজেকে সমর্পণ।
ছোট্ট বিছানায় শুধু এপাশ-ওপাশ করা। কিছুতেই ঘুম আসছে না। ঘর থেকে বেরোলাম টয়লেট যাবার উদ্দেশ্যে। চারিপাশে নিঃসীম নির্জনতা। ভয়ে ভয়ে টয়লেট থেকে ফিরে এসে আবার লেপের তলায়। কিন্তু ঘুম এলো না। ঘন্টা দুয়েক পরে আবার টয়লেট পেল। আমাকে রুম থেকে বের হতে দেখে উপল সঙ্গ নিল। এবার আকাশের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। দ্বাদশীর প্রায় পূর্ণতা প্রাপ্ত চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে উপত্যকা। কণা মাত্র মেঘের দেখা নেই।
সেই আলোকে ভাস্বর হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে অন্নপূর্ণা-শৃঙ্গরাজি ও মাছুপুছরে। সূর্যের আলোয় আলোকিত পর্বত শৃঙ্গ তো অনেকেই দেখেছে। মধ্যরাত্রে চাঁদের আলোয় হিমালয়ের অদৃশ্যপূর্ব রূপ সত্যিই অনবদ্য বিস্ময়কর।মাইনাস ৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে খোলা হাওয়ার মধ্যে চাঁদের আলোয় ৩৬০ ডিগ্রী রজত শুভ্র শৃঙ্গরাজির মাঝে কাটানো মধ্যরাতের এই দু'ঘণ্টা আমার জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
পঞ্চম দিন।
সূর্যের আলো দেখা দেওয়ার বেশ কিছু আগেই পৌঁছে গেলাম ভিউ পয়েন্টের কাছে। ধীরে ধীরে দিনের প্রথম আলো অন্নপূর্ণা ওয়ান-এর ললাট দেশে চুম্বন করল। ধীরে ধীরে শ্বেত শুভ্র শৃঙ্গরাজিতে শুরু হয়ে গেল আগুন রঙের আবির দিয়ে খেলা। বাম দিক থেকে সোনালী রং মেখে দাঁড়িয়ে অন্নপূর্ণা সাউথ,হিম চুল্লি, বরাহ শিখর,অন্নপূর্ণা ওয়ান, গঙ্গাপূর্ণা, অন্নপূর্ণা থ্রি ,মাছুপুছরে ও মাদ্রি হিমাল।
প্রাতরাশ সেরে এবার নামার পালা। এক অসাধারণ অভিজ্ঞতাকে সঞ্চয় করে আমরা নামতে শুরু করলাম। ফিরতি পথে একটা অর্ধেক বরফ জমে থাকা জলাশয়ের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সকালের আলোয় জলের এর ওপর ধবল শুভ্র শৃঙ্গরাজির প্রতিচ্ছবি। আজ একেবারে মাছুপুছরে বেস্ ক্যাম্প, দেওরালি, হিমালয়া হয়ে দোভানে রাত্রি বাস। নামার সময় হাঁটুর পরীক্ষা। কারো চোট লাগলো,কারো বা পা মচকালো। যারা ওঠার সময় লাঠি ছাড়া উঠেছিল তাদেরও লাঠির দরকার পড়লো। আমার হাঁটুও এত বছর ধরে শরীরের বোঝা বইতে বইতে এখানে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। হিমালয়া তে মধ্যাহ্নভোজন শেষ করে দোভানে পৌঁছাতে রাত্রি হয়ে গেল।
ষষ্ঠ দিন।
আজ দোভান থেকে চোমরং পর্যন্ত যাত্রা। আজকের রাস্তা একই চেনা পথে। শুধু উতরাই নয় অনেক চড়াইও এ পথের সঙ্গী। বাম্বু পেরিয়ে সিনুয়া তে এসে মধ্যাহ্নভোজ। তারপর খাড়াই নেমে এসে হ্যাঙ্গিংব্রিজ ।এরপর প্রায় ২০০০ সিঁড়ি চড়াই এর পর একটা চোরতেন।ট্রেকের এই অংশে ঘোড়ার উপদ্রব ভয়ঙ্কর।চোমরঙে ঢোকার মুখে কনজারভেশন এরিয়া থেকে বেরোনোর পারমিট চেক করিয়ে ঢুকে পড়লাম এক জার্মান বেকারি তে। চকলেট পেস্ট্রি ও ক্যাপুচিনো কফি তে চুমুক দিয়ে আজকের ক্লান্তির অবসান ঘটালাম।
সপ্তম দিন।
আজ দোভান থেকে চোমরং পর্যন্ত যাত্রা। আজকের রাস্তা একই চেনা পথে। শুধু উতরাই আজ আমাদের ট্রেকের শেষ দিন। চোমরঙ থেকে নামবো আমাদের যাত্রা শুরুর স্থান সোমরঙে। আজ আকাশ পরিষ্কার। চোখের সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অন্নপূর্ণা সাউথ এবং মাছুপুছরে। প্রাতরাশ সেরে ধবল শুভ্র শৃঙ্গ রাজিকে বিদায় জানিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম। একটা কালো মাথার পাখি কেমন একটা করুণ স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে। বোধহয় Rufous Sibia। আজ আমাদের ঝিনুর উষ্ণ প্রস্রবণে গা ভেজানোর কথা ছিল কিন্তু বারোটার পর পোখরার রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হবে শুনে সেই পরিকল্পনার ইতি টানলাম। চলতে থাকলো বিভিন্ন মাপের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা। ক্রমশ হাঁটুর উপর চাপ পড়তে পড়তে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। রাস্তার বাঁক ঘুরতে নিচে প্রতীয়মান হল নেপালের দীর্ঘতম হ্যাঙ্গিং ব্রিজ। তাকে লক্ষ্য করে নিচে নামতে শুরু করলাম। এইভাবে হাজার হাজার সিঁড়ি ভেঙে উতরায়ের পথে পৌঁছে গেলাম ঝিনু। আবার সেই দোদুল্যমান হ্যাঙ্গিং ব্রিজ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম সোমরং।
তারপর পোখরায় একরাত্রি বাস করে পরের দিন বীরগঞ্জ। সেখানে একরাত্রি থেকে রওনা দিলাম পাটনার উদ্দেশ্যে। এখান থেকে প্লেনে চেপে জীবনের সুন্দরতম এক স্মৃতি নিয়ে কলকাতায় ফেরা। ফেরার পথে একসাথে নতুন এক ট্ট্রেকিং এর পরিকল্পনা শুরু হয়ে গেল। নতুন পথ,নতুন অপেক্ষা, কবে আবার আসবো হিমালয়ের কোলে।
ছবি: লেখক
লেখক পেশায় একজন চিকিৎসক।
Comments